Monday, February 23, 2015

বামুনের চাঁদে হাত, পর্ব-৪






বামুনের চাঁদে হাত

মনোজকুমার দ. গিরিশ 






৬টির
পর্ব-৪








লেখাটি ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’AhanLipi-Bangla14 ফন্টে পড়লে লেখাটির উদ্দেশ্য স্পষ্ট হবে৤ ফন্ট ফ্রি ডাউনলোড করার লিংক:
https://sites.google.com/site/ahanlipi/font-download/AhanLipi-Bangla14.zip






সঙ্গে দেওয়া ফাইল দেখে নিতে হবে৤

অহনলিপি-বাংলা১৪ ডিফল্ট টেক্সট ফন্ট সেটিং
(AhanLipi-Bangla14 Default text font setting)
Default text font setting ডিফল্ট টেক্সট ফন্ট সেটিং

এবং



অহনলিপি-বাংলা১৪ ডিফল্ট ইন্টারনেট সেটিং
(AhanLipi-Bangla14 Default Internet setting)

(Default font setting ডিফল্ট ফন্ট সেটিং)

on internet(Mozilla Firefox)
(top left) Tools  
              Options--contents
              Fonts and Colors
              Default font:=AhanLipi-Bangla14
                        Advanced...
                                    Fonts for: =Bengali
                                    Proportional = Sans Serif,   Size=20
                                    Serif=AhanLipi-Bangla14
                                    Sans Serif=AhanLipi-Bangla14
                                    Monospace=AhanLipi-Bangla14,  Size=20
                                    -- OK
            Languages
            Choose your preferred Language for displaying pages
            Choose
            Languages in order of preference
            Bengali[bn]
            -- OK
 -- OK

          এবারে ইন্টারনেট খুললে ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’ ফন্টে সকলকিছু দেখা যাবে৤ নেটে এই ফন্টে সব কিছু লেখাও যাবে৤







৬টির
পর্ব-৪




          যাহোক, আমি আমার মতো এজন্য একটি কিবোর্ড তৈরি করেছি৤ প্রথমে প্রস্তুত করলাম বাংলা বর্ণের ব্যবহারের তুলনাংক(letter frequency), এবং তারপরে বের করলাম কিবোর্ডে টাইপ করতে কোন্‌ ‘কি’-তে হাত সহজে চলে তারও একটি তুলনাংক, বলা যেতে পারে accessibility frequency of Keytops. এবার দুটির হিসেব মিলিয়ে বাংলা কিবোর্ডের নক্সা তৈরি করা হল৤ তারপরে সেই মতো কিবোর্ড তৈরি করে লেখালিখির কাজ শুরু হল৤ কিছুদিন পরে বিবেচনা করে দেখলাম যে এতে কিবোর্ডে যে কি-সিকোয়েন্স তথা কি-পজিশন তাতে বাংলা হরফ অনেকটাই মুখস্থ করে মনে রাখতে হয়৤ অন্যদের তৈরি কিবোর্ড ব্যবহার করে দেখেছি সেখানেও এই একই অবস্থা৤ 


      তখন ভেবে দেখলাম যে আমাদের সবার কাছেই ইংরেজি কিবোর্ড থাকে, তাই ইংরেজি হরফ মিলিয়ে বাংলা কিবোর্ড তৈরি করলে তা অনেক বেশি সুবিধাজনক হবে৤ তখন আবার ইংরেজি হরফের ধ্বনির সঙ্গে বাংলা হরফের ধ্বনির মিল রেখে নতুন করে বাংলা কিবোর্ড তৈরি করেছি৤ আর এতে কাজ করার জন্য কিবোর্ড বেশ সুবিধাজনক হয়েছে৤ কিটপ খুব অল্পই মনে রাখতে হয়৤ এই কিবোর্ডে লেখার জন্য কি-টপ নির্দিষ্ট হয়েছে k, অর্থাৎ ব্যঞ্জনবর্ণ ‘ক’ হল ইংরেজি হরফ k, অর্থাৎ k=, g=, c=, j=, t=, d=, n=, p=, f=, b=, v=, m=, r=, l=, s=, h=, y= ইত্যাদি(১৭টি), আর শিফট চেপে লেখা যাবে K=, G=, J= T=, N=, D=, Z=য, S=(৮টি), এবং স্বরবর্ণ A= মোট(১৭++=) ২৬টি পূর্ণ বর্ণ৤ এছাড়া, Alt=AltGr(ডান হাতের বা ডানদিকের Alt) চেপে লেখা যাবে-- অ   (৭টি)৤  

      আর AltGr+shft চেপে লেখা যাবে--,,,(৪টি), এই  সর্বমোট ৬+৭+৪=৩৭টি পূর্ণবর্ণ৤ বাকিগুলি(৫০-৩৭=১৩টি) মনে রাখতে হবে৤ তবে সেগুলিও বেশ লজিক্যাল করা হয়েছে যাতে সহজে মনে রাখা যায়৤ যেমন ‘শষস’ একটি কি-তে করলে তার উপরে বেশি চাপ পড়বে, কারণ কারণ শ এবং স-এর ব্যবহার খুব বেশি৤ তাই s=S= করা হয়েছে৤ আর s-এর ঠিক উপরের সারির প্রায় একই খাড়া রেখায় থাকা w -কে করা হয়েছে শ৤ এতে মনে রাখা সহজ হয়েছে৤ এমনকী w-এর চেহারার সঙ্গে শ-এর একটি দূর সাদৃশ্যও আছে৤ 

         আগের কিবোর্ডে অনেক বেশি মনে রাখতে হত৤ অন্যদের করা একটি কিবোর্ডে যেমন দেখেছি, j=র৤ এভাবে অনেকগুলি কি-টপ মনে রাখা বেশ কঠিন নয় কি? আমি সে কিবোর্ডেও বহুদিন কাজ করেছি৤ মুখস্ত রেখেই করতে হয়েছে৤

          যাহোক, বি বি চৌধুরির সুপরামর্শ, এবং পরে বিশ্বরূপ ভৌমিকের কথা মতো বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করার চেষ্টায় লেগে গেলাম৤ কিন্তু দেখলাম যে নন-ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করার সুবাদে ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করা আমার মতো বামুনের পক্ষে প্রায় অসম্ভব৤    

         তবু লেগে রইলাম৤ দেখলাম যে নেটে একটি সাইটে এবিষয়ে সহায়তা আছে৤ তা ডাউনলোড করে তা দেখে, বহু চিন্তাভাবনার পরে বহু চেষ্টায় শেষ অবধি বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করা সম্ভব হল৤ বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করার সহায়তার সফ্‌টওয়্যারের বিপুল বহর এবং জটিলতা দেখে আর এগোনোর সাহস হয় না! তাছাড়া, আমি যে পদ্ধতিতে বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করতে চাই, তা চলতি ফন্টের মতো নয়, ফলে সমস্যা আরও অনেক বেশি৤

          বাংলায় আছে কম করে প্রায় ৩৯৫টি যুক্তবর্ণ বহুদিনের অনুসন্ধানে তা উদ্ধার করা গেছে৤ তার আগে এনিয়ে আমি বইপত্র ঘেঁটে দেখেছি, কোথাও যুক্তবর্ণের তেমন তালিকা নেই৤ ঘাঁটতে গিয়ে অবশ্য অন্য অনেক কাজের জিনিস পেয়েছি৤ ছাপাখানায় টাইপ হাতেকম্পোজ করা শেখার যে বই, তা খুঁজে বেশ খানিকটা যুক্তবর্ণ উদ্ধার হল, কিন্তু তাতে অনেকটা বাকিও রয়ে গেল৤ তাই রোজকার খবরের কাগজ, নানা বইপত্র, পাঠ্যপুস্তক, পত্র-পত্রিকা দেখে দেখে দিনে দিনে একটু একটু করে এই সঞ্চয় বেড়েছে৤ 


        বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করার পরে পরীক্ষা করে দেখতে হল, বাংলা সমস্ত যুক্তবর্ণ সেই ফন্ট দিয়ে লেখা যায় কিনা? কারণ আমার যুক্তবর্ণ লেখার পদ্ধতি আলাদা, সম্পূর্ণ স্বচ্ছ৤ কম বাংলা জানা মানুষ, ইংরেজি মাধ্যমে পড়া বাঙালি শিশু, এবং বিদেশিদের পক্ষেও এই ধরনের যুক্তবর্ণ খুবই সহায়ক৤ লিখতে, বুঝতে বা পড়তে কোনও অসুবিধে তো নেইই বরং সুবিধা হয়েছে অনেক৤ 

          দেখা গেল আমার প্রস্তাবিত পদ্ধতিতে সম্পূর্ণ স্বচ্ছ বাংলা যুক্তবর্ণ লেখায় ইউনিকোড ফন্ট সফ্‌টওয়্যার আয়তনে অনেকটাই ছোটো হয়েছে৤ অন্যদের যেখানে ৩৫০ থেকে ৭০০ কেবি, সেখানে আমার করা ফন্ট মাত্রই ৯০ কেবি-র মধ্যে৤ এতে মেমোরির উপরে চাপ অনেক কম৤ ক্ষ, জ্ঞ-- মাত্র এই দুটি দলা পাকানো যুক্তবর্ণ ছাড়া আর কোনও দলা পাকানো যুক্তবর্ণই নেই৤ ‘যাহা করিব স্বচ্ছ করিব’-- এই নীতি আমার মতো ফন্ট নির্মাতার পছন্দ হলেও লোকের অবশ্য পছন্দ নয় তেমন৤ রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে, সহজ কথা যায় না লেখা সহজে’  তাই বোধহয় হরফের প্যাঁচে আমরা জড়িয়ে আছি সদা৤ 

          তবে একটি কথা বলা দরকার যে, কিছু অতি সহজ শব্দ কিন্তু ইউনিকোড ফন্টে লেখা সহজ নয়, বরং বেশ কঠিন, এটার কারণ হল বাংলা ইউনিকোড ফন্টের নিজস্ব প্রকৃতি৤ যে কেউ বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করুন, এই সমস্যার সমাধান তাঁকে করতেই হবে৤ আমার ফন্টেও এই সমস্যার সমাধান করা হয়েছে৤ ভুরি ভুরি যত পৃষ্ঠা লেখা হয়ছে, কোনওখানে লিখতে আটকায়নি৤ যখনই কোনও সমস্যা দেখা দিয়েছে তখুনি তার সমাধান করে, এগোনো  হয়েছে৤ যেমন--

র়্যা‍পার লিখতে গেলে তা লেখা কঠিন, 

কারণ তা হয়ে যাবে র্যাপার৤ 

বেগ্‌নি রঙের শাড়ি,   কেব্‌লের বিল 


এসব শব্দ খুব সহজ, কিন্তু লেখা কঠিন৤ এটা ইউনিকোডের নিজস্ব প্রকৃতি৤ এমনি বেশ কিছু শব্দ আছে, তবে তার সমাধানও এখানে করা হয়েছে৤ এধরনের শব্দ লেখার কৌশল শিখে নিতে হবে৤

         তবে অনেক বিচিত্র করে লেখার সুবিধেও তেমনি আছে, যেমন--

ক্‌ষ      ক্‍ষ          ক্ষ 
জ্‌ঞ    জ্‍ঞ         জ্ঞ


      
      বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করার পরে আমি নিজের বেশ কয়েকটি বাংলা ব্লগ তৈরি করেছি৤ সেখানে এই ইউনিকোড ফন্টে লেখালিখি শুরু করলাম৤ কারণ এতে এই ফন্টটির ব্যবহার-যোগ্যতা প্রমাণ হতে পারবে৤ ব্যবহারিক পরীক্ষা হলে তবেই তা কাজের হবে৤ মোটোর গাড়ি শহরের মসৃণ রাস্তায় গড়গড় করে চলে, গ্রামের এঁদো পথে তা টিনের বাক্স! সেই গ্রামীণ জীবনেও এই ফন্টকে চলতে হবে তাই তার পরীক্ষা আরও কঠিন৤

          বাংলা যুক্তবর্ণের যে রীতি আমি ব্যবহার করেছি, তার জন্য যুক্তবর্ণের দুটি সূত্র তৈরি করেছি৤ সূত্র দুটি হল, 
(১) 


এবং  

(২)




         এখানে সকল বাংলা বর্ণই মাত্রা ঘেঁষে বসবে, ইংরেজির মতো ভূমিরেখা ধরে নয়৤ তা বোঝাতে সূত্র দুটির হরফ এমনি করে সাজানো৤ ইংরেজিতে লেখা হয় ভূমিরেখা ধরে৤ 


(১)

এবং 

(২)




         করেই লেখা দরকার, কারণ বাংলা লেখা তো ইংরেজির মতো লাইনের উপরে দাঁড়ানো হয় না, বরং তা মাত্রা সংলগ্ন হয়৤ 



         সূত্র দুটি সকল কমপ্লেক্স স্ক্রিপ্টের ক্ষেত্রেই কাজে লাগতে পারে৤ দরকারে তা আর একটু বর্ধিত করে নেওয়া যেতে পারে,

 ‘সি১সি১সি১সি২’   



         এমনিভাবে, কারণ কোনও কোনও ভাষায় বেশি বর্ণ নিয়েও যুক্তবর্ণ হয়, কাল্পনিক ভাবে যেমন-- (২ বর্ণ) ক্সু, ক্পী ইত্যাদি, (৩ বর্ণ)ক্ক্সু, ত্ক্পী ইত্যাদি, (৪ বর্ণ)ক্ক্ক্সু, ল্ত্ক্পী ইত্যাদি, অথবা (৫বর্ণ)ক্ক্ক্ক্সু, ল্ত্ক্প্গী ইত্যাদি৤ বাংলায় যেমন দুই বর্ণ-- ক্ত=শক্ত, তিনবর্ণ--স্প্ল=স্প্লিট৤



          প্রথম প্রজন্মের বাংলা ফন্টের পরে, দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলা ফন্ট, তারপরে তৃতীয় প্রজন্মের ফন্ট ও অবশেষে চতুর্থ প্রজন্মের চূড়ান্ত বাংলা ফন্ট কী হবে, কেমন হবে, তাও তৈরি করা হয়েছে৤ এখন আমি যে ফন্টটি ব্যবহার করি তা হল, অহনলিপি-বাংলা১৪ (AhanLipi-Bangla14.ttf), এটি দ্বিতীয় প্রজন্মের বাংলা ইউনিকোড ফন্ট৤ এটি  .ttf টিটিএফ ফন্ট বলে দেখালেও এটি আসলে ইউনিকোড ফন্ট৤





          এখন কম্পিউটারে যে ফন্টে লেখালিখি হয় সেগুলো হল প্রথম প্রজন্মের ফন্ট(First Generation Font)৤ পুরানো দিনে যেভাবে হাতে ছাপার ছাপাখানায় ছাপা হত, ঠিক সেই ভাবেই কম্পিউটারের জন্যও বাংলা ফন্ট তৈরি করা হয়েছে৤ 


          পরবর্তী কালে কিছু ইউনিকোড ফন্টও তৈরি হয়েছে৤ কারিগরি দিক থেকে আভ্যন্তরীন ভাবে ইউনিকোড ফন্ট আমূল পরিবর্তিত হলেও কিন্তু লিপির গঠনগত দিক থেকে তার কিছু মাত্র পরিবর্তন হয়নি৤ এক কালে(১৯৩৫ খ্রিঃ) যখন লাইনোটাইপ চালু হয়েছিল, তখন আনন্দবাজার পত্রিকায় বাংলা লেখার রীতির অনেক অগ্রগতি হয়েছিল৤ বাংলা যুক্তবর্ণের গঠন রীতি অনেক সহজ হয়ে এসেছিল৤ এর কারণ যাঁদের মূল চিন্তা ভাবনার প্রভাব রয়েছে এই টাইপ গঠনে তাঁরা চেয়েছিলেন বাংলা যুক্তবর্ণের গঠনরীতি সহজ হোক, নইলে বাংলা ছাপার অগ্রগতি হবে না৤ 


       তাঁরা গত শতাব্দীর প্রথম দিকেই তা ভাবলেও তা এখনও আমাদের কাছে অধরাই রয়ে গেছে৤ যাঁর মূল ভাবনার ফসল এই লাইনোটাইপের স্বচ্ছযুক্ত বর্ণ, তিনি হলেন অজরচন্দ্র সরকার৤ তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুদ্রণশালার সঙ্গে দীর্ঘদিন জড়িত ছিলেন৤ তিনি জীবনভর যে অমূল্য অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন তার সুফল হল লাইনোটাইপের স্বচ্ছ, সহজ যুক্তবর্ণ৤ যদিও তিনি কোন বিশেষ কারণে অচেনা অপরিচিতই রয়ে গেছেন৤ তবুও, এতকাল পরে তাঁকে যে আমরা মরণোত্তর শ্রদ্ধা জানাতে পারছি সেটাও কম কথা নয় [এ উদ্দেশ্যে একটি সাময়িক পত্রিকা দেখা যেতে পারে-- ‘বাংলা টাইপ ও কেস’, অজরচন্দ্র সরকার, বর্ণপরিচয়, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, নভেম্বর-ডিসেম্বর ২০০৯, পৃঃ-২৩১-২৩৬]৤


          লাইনোটাইপের স্বচ্ছ এবং সহজ যুক্তবর্ণব্যবস্থা থেকে কেন আমরা পিছিয়ে এলাম? তার মূল কারণ আমার মনে হয়, ব্যবসায়ে অধিক লাভের প্রয়াস৤ ভাষার অগ্রগতির ভাবনা ব্যবসার কাছে হার মেনেছে৤ কী সেটা? দলা পাকানো মণ্ড-হরফ করে যুক্তবর্ণ লিখলে কম যায়গাতে কাজ সারা যায়, আর সহজ, স্বচ্ছ যুক্তবর্ণ লিখলে লেখার জায়গা বা মুদ্রণস্থান লাগে বেশি৤ এতে ছাপার জন্য কাগজ বেশি লাগে, ব্যবসার ব্যয় বাড়ে৤ তাই, লাইনো টাইপের যুগের পরে যখন কম্পিউটার কম্পোজিং শুরু হল তখন আবার আগেকার হাতে ছাপা যুগের মতো হরফের দলা পাকানোও শুরু হল৤ বিদেশিরা বাংলা শিখতে চাইলে কি এসব কুটিল ব্যবস্থার শিকার হচ্ছেন না? হচ্ছেন, অবশ্যই হচ্ছেন৤ আমি ওডিয়া শিখতে গিয়ে যুক্তবর্ণের ফাঁদে পড়ে পিছিয়ে গেয়েছি৤


       সহজ করে লেখা ‘ত্র’ স্থানে ‘—এ’ লেখা শুরু হল (আর অপরিবর্তিতই রইলো —ও, ষ৏ ) ইত্যাদি৤ এরকমভাবে অন্য সকল যুক্তবর্ণও, যেগুলি সহজ করে লেখা চালু হয়েছিল তা সহজ করে না-লিখে মণ্ড করে লেখা চলতে লাগল, ঠিক পুরানো দিনের ছাপার বা হাতের লেখার মতো করে৤ মুদ্রণ জগতে এতে চলনগতি দুরকম হল, একটি হল যান্ত্রিক কারিগরি অগ্রগতি, আর অন্যটি লিখনের তথা ভাষা ব্যবস্থার পশ্চাৎগতি৤ এতে মোদ্দা ব্যাপারটার নিট ফল হল শূন্য, প্রায় স্থাণু হয়ে থাকার মতো ব্যাপার হল৤ 

          উল্লেখ্য বাংলা ছাপার টাইপ তৈরি হয়েছে প্রধানত তিনজনের হাতের লেখাকে অনুসরণ করে, তাঁরা হলেন কালীকুমার রায়, হরমোহন দত্ত এবং খুশমৎ মুন্সি৤ হরফ সংযোজন তথা কম্পোজিং, এবং ছাপার যত যান্ত্রিক উন্নতি হল ততোই যেন লিপির মণ্ডীকরণও বেড়ে গেল৤ এ যেন কোট  টাই প্যান্ট পরিচ্ছদের সঙ্গে পায়ে খড়ম দিয়ে চলা! প্রক্রিয়া আধুনিক, আর ব্যবস্থা সেই প্রাচীন৤ আমরা কম্পিউটারের মতো চমকপ্রদ আধুনিক যান্ত্রিক ব্যবস্থাকেও গরুর গাড়িতে জুতে দিলাম৤ ইহাতে প্রমাণ হইল যে, কম্পিউটার সব পারে! ঠিক যেন, “কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল, সে মরে নাই

          যারা লাইনোটাইপের আধুনিক ব্যবস্থা প্রথম প্রচলন করল তারাই আবার হরফ বিন্যাসে সবচেয়ে পিছিয়ে গেল৤ এমনকী আনন্দবাজার পত্রিকা তাদের সম্মুখাভিমুখী চলার পথে বানানে ‘পার্ক’(Park) না লিখে, লিখতে শুরু করেছিল ‘পারক’৤ এই যে অগ্রগতির প্রবল প্রয়াস তার বিরুদ্ধে সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের মতো প্রাচীনপন্থীরা সরব হলেন-- বাংলায় ‘পারক’ মানে তো দক্ষ৤ ফলে এই প্রয়াস বন্ধ হয়ে গেল৤ (পারক Parak, এবং পার্ক/পারক Park শব্দ দুটির উচ্চারণ কিন্তু আলাদা৤ একটি পা র৹ ক, অন্যটি পার্​ক৤ এখানে অ-চিহ্ন=৹, এবং হস্‌=্ চিহ্ন বাহ্যত দেখানো হয়নি[পার৹ক শব্দের উচ্চারণে হলন্ত ধ্বনি ‘ক’-এ(=ক্‌), আর ‘পার্‌ক’ শব্দে র এবং ক এই দুটির ধ্বনিই হলন্ত, যেন পার্‌ক্=পার্ক্‌ =পার্‌ক্]৤ পার৹ক লিখলে উচ্চারণে বিভ্রাট কিন্তু সত্যিই হতে পারে৤ তবে পারক=দক্ষ, শব্দটি বাংলায় লাখের মধ্যে একটি ব্যবহারের সম্ভাবনা মাত্র৤ আসল কথাটি অন্যত্র, তা হল, এই স্বাধীনতা নিলে ভবিষ্যতে এমনি ভুরি ভুরি শব্দ লেখা হবে, যা হয়তো কাম্য নয়, এতে ভাষায় বিপর্যয় দেখা দিতে পারে৤ কিন্তু যে বিশাল অগ্রগতির সংকেত এতে আছে, তা হেলার যোগ্য নয়৤ আর শেষে কম্পিউটার ডিটিপি-তে (Desk Top Printing) এসে আনন্দবাজার পত্রিকা নিজেরাই প্রাচীনপন্থার হাতে নিজেদের সমর্পণ করল৤ এটাকে সকৌতুকে বলা যাবে কি, ব্যবসা বড় দায়!

          আনন্দবাজারের নতুন দিনের ডিটিপি টাইপ তৈরি করে দিয়েছেন বাংলা টাইপোগ্রাফিতে দক্ষ একজন ইংরেজ মহিলা (ডঃ)ফিয়োনা রস(এ ব্যাপারে অবশ্য অন্য একজনের নামও এপ্রসঙ্গে শুনেছি, তিনি দুলাল সরকার)৤ আনন্দবাজারের প্রয়োজন এবং অভিপ্রায় অনুসারে ডঃ রস কাজটি করে দিয়েছেন৤ লাবণ্যময় ফন্ট-টাইপের নির্মিতি যে খুবই সুন্দর হয়েছে সেটা স্পষ্ট৤ এই অভিরাম টাইপে কেন অগ্রগতি ঘটানো গেল না? ব্যবসা বাঁচানো? কিন্তু ভাষা বাঁচানোর কি দরকার নেই? বাংলা ভারতের শ্রেষ্ঠভাষা৤ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা৤ প্রকাশ ক্ষতায় তা অতুল৤ মুদ্রণ পারিপাট্যে অনুকরণীয়, হরফ বিন্যাসে নয়নাভিরাম৤ আর সাহিত্যে তো শত বর্ষ পূর্বেই বাংলায় নোবেল পুরস্কার এসেছে, যা ইউরোপের বাইরেও বিশ্বে প্রথম৤ বাংলারভাষার মাধুর্যের ব্যাপারে কিছুদিন আগে একটি খবর প্রকাশিত হয়েছিল, ...is to be believed, Bengali has been voted the sweetest language in the world.(Times of India, Apr 22, 2010, Sweetest language tag for Bengali? TNN | Apr 22, 2010)৤  সেই ভাষার অগ্রগতির অভিমুখের দিকে অবধি পিছন ফিরিয়ে থাকা কোন্‌ বিবেচনায়?

          যাহোক, এখনও কিন্তু বাংলা ‘ছাপাখানায়’ ইউনিকোড ফন্ট ঢুকতে পারেনি, পুরানো সেই নন-ইউনিকোড ফন্টেই লেখা এবং ছাপা চলছে৤ বাংলা নাকি সবার আগে ভাবে৤ তবে এখন সবার পিছনে হাঁটছে৤ কম্পিউটারে কিছু হয়তো বাংলা ইউনিকোড ফন্টে লেখালিখি হয়, বিশেষ করে নেটে, ফেসবুকে, তবে সেখানে এখনও প্রথম প্রজন্মের ফন্ট(First Generation Font) ব্যবহার করে কাজ চলছে, যদিও তা কারিগরি দিক থেকে উন্নত ইউনিকোড ফন্টই৤ দরকার ছিল দ্বিতীয় প্রজন্মের ইউনিকোড ফন্টে পৌঁছে যাওয়া৤ 

          আমার তৈরি ফন্টগুলি দ্বিতীয় প্রজন্মের ফন্ট (2nd Generation Font )৤ কারিগরি দিক থেকে পুরানো দিনের ‘নন-ইউনিকোড ফন্ট’ তৈরির সময় থেকেই আমার ফন্টগুলি দ্বিতীয় প্রজন্মের ফন্ট৤ সে দিকে চোখ রেখেই আমার ইউনিকোড ফন্টগুলি তৈরি করা হয়েছে, যা কারিগরি দিক থেকে অনেক উন্নত, অর্থাৎ প্রায়োগিক ভাবে দুটি দিক থেকেই এটি অনেক উন্নত৤ আর শুধু চলতি গঠনের ফন্টই নয়, সেখানে বিচিত্র ধরনের গঠনের ফন্ট আছে৤ সেই একাধিক ফন্টের মূল গঠনপ্রকৃতি কিন্তু ‘বাংলা ইনজিনীয়ারিং বর্ণমালা’-কে অনুসরণ করে গঠিত৤ 


        এগুলির মধ্যে আয়তাকার ধরনের নয় এমন একটি ফন্টই কেবল, সেটির চলতি ধরনের গঠন, তবে তাও দ্বিতীয় প্রজন্মেরই৤ ইউনিকোড ফন্টের ক্ষেত্রেও একই রীতি মানা হয়েছে 
(১)বিচিত্র গঠনের ফন্ট 
এবং 
(২)অনায়তাকার চলতি ধরনের ফন্ট, 
তবে তার সবগুলিই দ্বিতীয় প্রজন্মের ফন্ট৤


          দ্বিতীয় প্রজন্মের ফন্ট হল সম্পূর্ণ স্বচ্ছ যুক্তবর্ণের ফন্ট৤ এখানে —ও, —এ, ষ৏  ইত্যাদি করে পুরানো কায়দায় যুক্ত-বর্ণ লেখা হবে না৤ বরং লেখা হবে-- —ও=ত্ত, —এ=ত্র, ষ৏ =ষ্ণ এইভাবে৤ প্রথম দর্শনে খটকা লাগবে, ধাক্কাও দেবে জোর, কিন্তু একটু চোখ খুলে রাখলে, এটা যে আমূল যৌক্তিক ব্যাপার তা, না-মানার কোনও কারণ নেই৤ অবশ্য তা না-মানার একটা কারণ হতে পারে এরকম--“একবার যেটা অভ্যাস হইয়া যায় সেটাতে আর নাড়া দিতে ইচ্ছা হয় না৤ কেননা স্বভাবের চেয়ে অভ্যাসের জোর বেশি৤...অভ্যাসের সঙ্গে সঙ্গে একটা অহংকারের যোগ আছে৤ যেটা বরাবর করিয়া আসিয়াছি সেটার যে অন্যথা হইতে পারে এমন কথা শুনিলে রাগ হয়৤ মতের অনৈক্যে রাগারাগি হইবার প্রধান কারণই এই অহংকার৤... ”-- রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৤


          বাংলা ফন্টকে এর পরবর্তী ধাপেও যেতে হবে, তাই চাই তৃতীয় প্রজন্মের ইউনিকোড ফন্ট(3rd Generation Unicode Font)৤ সে উদ্দেশ্যে তৃতীয় প্রজন্মের বাংলা ইউনিকোড ফন্টও তৈরি করা হয়েছে৤ সে ফন্টে বাংলা লেখা হবে উচ্চারণ-ভিত্তিক বানানে৤ বহুকাল ধরেই যে-উদ্দেশ্যে অনেকেই তাঁদের কলম ধরেছেন৤ কিন্তু লোকের মনে কলমের সে চলনে কোনওই ঢেউ তোলেনি৤ তবে আমার মতো অতি সাধারণ মানুষ কিন্তু তেমনি লেখাই চায়, কারণ ভাষা সেখানে অনেক সহজ, অনেক অন্তরঙ্গ৤ সে ফন্টে কিছু পড়তে হলে, আরও অনেক বেশি মুক্তমনা হতে হবে৤ কষ্টটা/বিরক্তিটা হবে শিক্ষিত মানুষদের৤ সাধারণ মানুষ কিন্তু সহজটা চান৤ লিখব, পড়ব, শিখব-- কিন্তু সে জন্য পদে পদে এত ব্যত্যয়যুক্ত ব্যবস্থা কেন? তা কি মানুষের লেখাপড়া এবং জ্ঞান লাভের পথে বাধা নয়? এতে কি শিক্ষাছুট(dropout) হচ্ছে না? নাকি আমার মতো অতি সাধারণ এলেবেলে মানুষকে শিক্ষার, জ্ঞানের একাসনে বসাতে পণ্ডিতেরা রাজি নন? এলেবেলে লোকও বসবে এসে পাশে, সেই ত্রাসে সেটা মানা যাবে না৤ অথবা কে জানে, হয়তো তা নয়৤ তবে বাংলা লেখা, আর বানান সহজ হওয়া উচিত, এব্যাপারে দ্বিমত পোষণ কেন?

এব্যাপারে আমার একটি ব্লগের সংশ্লিষ্ট লিংক দেখা যেতে পারে, এখানে ক্লিক করে:--


          এরপরে কী? এখানে থেমে থাকলেও কিন্তু হবে না, তা যাতে ইংরেজি লেখার মতো, সহজ হয় সে চেষ্টার দিকে আরও এগিয়ে যেতে হবে৤ তাই তৈরি হয়েছে চতুর্থ প্রজন্মের বাংলা চূড়ান্ত ইউনিকোড ফন্ট (4th Generation Unicode Font)৤ সে ফন্টে লেখালিখি দেখতে হলে আগের এই লিংকেই যেতে হবে:--
http://banglamoy.blogspot.in/2014/09/blog-post_17.html


          বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে? ক্রেজ বলে মনে হচ্ছে? আসলে ক্রেজ না থাকলে কিছু করার উদ্যোগ তো থাকে না৤ সেটা অবান্তর, পাগলামি হতে পারে৤ পাগলে এলোপাথাড়ি দৌড়োয়, যদি কিছু পাওয়া যায়! তেমনিই হয়েছে, চেষ্টা করা হয়েছে নানা দিক থেকে৤ ফল? সেটা তো অন্য মানুষ, ভবিষ্যতের মানুষ বিচার করবে, এখন এযুগে বসেই তা নির্ণয় করা কঠিন৤


          জন মারডক(John Murdoch) বলে বাংলায় একজন ইংরেজ পাদ্রি এসেছিলেন, তিনি বিদ্যালয়ে পড়া, পড়ানো নিয়ে বহুদিন কাজ করেছেন৤ তিনি দেখলেন বাংলা লেখার রীতি ঠিক নেই, তাই তিনি বিদ্যাসাগরকে বাংলা লেখার ব্যাপার নিয়ে একটি চিঠি লিখে(২২-০২-১৮৬৫) বাংলাভাষা সংস্কারের এক প্রস্তাব দেন৤ যদিও তেমন করে বাংলা লেখা হয়না, তবে হওয়া উচিত বলে তাঁর বিদগ্ধ সিদ্ধান্ত৤ 

        অবশ্য তিনি লিখেছেন, এই চিন্তাকে আজ উপহাস করা হবে, কিন্তু ভবিষ্যতে এমনি হবে, বা এমনি করতে হবে৤ তাঁর সে অনুমান বৃথা যায়নি৤ আজ যে স্বচ্ছযুক্তবর্ণের কথা বলা হচ্ছে তা তাঁর বক্তব্যের বিরোধী নয়৤ ন্যাথানিয়েল ব্র্যাসি হ্যালহেডের বইতে বাংলা ছাপার জন্য চার্লস উইলকিনস যে হরফটাইপ বানিয়ে দিয়েছিলেন তা মারডকের বক্তব্যের সঙ্গে মেলে৤ লাইনোটাইপে যেভাবে ছাপা হত তার সঙ্গে মারডকের বক্তব্যের সাজুয্য আছে৤ 


         ‘যারে তুমি নীচে ফেল সে তোমারে বাঁধিবে যে নীচে পশ্চাতে রেখেছ যারে সে তোমারে পশ্চাতে টানিছে...’৤ বাংলা লিখনব্যবস্থায় সেই পিছুটান বাংলার অগ্রগতি ব্যাহত করছে৤ সেদিকে নজর দিতে হবে৤ 


           রবীন্দ্রনাথের বলা “পাড়ায় যত ছেলে এবং বুড়ো সবার আমি একবয়সী জেনো”৤ সমসময়ের সঙ্গে সহজে মসৃণ পথে চলতে হবে৤ আধুনিক জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সুযোগ পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করতে হবে৤ সেই প্রাচীন হাতেলেখা পুথির যুগে পড়ে থাকা নয়, ব্রাহ্মীলিপির লিখনরীতির যুগে পড়ে থাকা নয়, পড়ে থাকা নয় মিশরের সেই অতি প্রাচীন হায়ারো গ্লিফিক লিখনরীতিতে৤ বরং বর্ণ, ধ্বনি, লিপি তাদের সম্পূর্ণ সৌন্দর্য, সকল সম্পদ, যাবতীয় রিক্‌থ নিয়ে যেন হাজির হয় আমাদের কাছে৤ 


        না হলে কী হবে, সে তো বোঝা-ই যাচ্ছে, সবাই ক্রমে এগোবে আর আমরা স্থবিরতার মোহে মুগ্ধ হয়ে, কূপমণ্ডূক হয়ে ঘ্যাঙর ঘ্যাং করতে থাকব৤ পৃথিবীর একটি শ্রেষ্ঠভাষার তাহলে আর আমরা যোগ্য রইলাম কই? কেনইবা রবীন্দ্রনাথ ‘বাংলা’ নামক এক অপরিচিত ভাষাকে তাঁর অতুল প্রতিভাময় সেবা দিয়ে বিশ্বের শীর্ষভাষা করে তুললেন? একটু নড়ে বসতে তো হবেই, সবাই গড় গড় করে এগোচ্ছে, আর আমরা বসে বসে বিস্ময়ে দেখছি, এটা চলতে পারে না, আমাদেরও একটু পা চালাতে হবে৤ একটু পা চালিয়ে আগাই৤ 


          বাংলায় প্রথমদিকে কম্পিউটার ফন্ট বানাবার অনেক পরে এলো কম্পিউটারে অত্যাধুনিক ফন্ট বানাবার নতুন কোড পদ্ধতি৤ সেটাকে বলে ইউনিকোড পদ্ধতি৤ তাই আগের ফন্টের গোষ্ঠীগত নাম হয়ে গেল, নন-ইউনিকোড ফন্ট৤ নন-ইউনিকোড ফন্ট করা গেলেও, এবার ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করতে গিয়ে দেখা গেল, আগের নন-ইউনিকোড ফন্ট যদি হয় নদী, তবে ইউনিকোড ফন্ট হল মহাসাগর৤ সেখানে ডোবা সহজ, পার হওয়া কঠিন৤ 


        তাই ইউনিকোড ফন্ট বানাবার সহায়তা খুঁজতে লাগলাম, কোথায় কীভাবে সহায়তা পাওয়া যায় তার চেষ্টা চলতে লাগল৤ খুঁজে খুঁজে অবশেষে পাওয়া গেল তেমন সহায়তা৤ সেখানে একটি তেমন ইউনিকোড ফন্ট বানানোর উদাহরণ দেখানো আছে৤ ভরসা পেলাম, কিন্তু সেখানে তো চালু পদ্ধতির যুক্তবর্ণ দেখানো হয়েছে, যা আমার পদ্ধতির সঙ্গে মিলবে না৤ আর অতি বিশাল তার আয়তন, এবং আয়োজন৤ তার বিপুল আয়োজনের দিকে, তার অতীব জটিলতার দিকে তাকালে বুক হিম হয়ে যায়৤ তবু লেগে গেলাম তাকে বাগাতে৤ একটু একটু করে এগোতে লাগলাম, এক-এক পা করে৤ একবারে বেশি এগোলে যদি আটকে যাই তবে সব কিছু মুছে, আবার গোড়া থেকে শুরু করতে হবে৤ নয়তো সেখান থেকে বের হওয়া কঠিন৤ বের হওয়া যাবে না৤ যদি বিন্দুমাত্র আলস্য করা হয় তবে ফাঁদে পড়তে হবে৤ তাই কোন ঝুঁকি না নিয়ে খুব ধীরে ধীরে এগোতে লাগলাম৤ এক পা এগোই, আবার পরীক্ষা করি৤ সে পরীক্ষারও অনেকগুলি করে ধাপ৤ সুতরাং মাথায় বিরাট বোঝা নিয়ে ডন-বৈঠক করার মতো অবস্থা৤ কিন্তু কোনও ঝুঁকি না নিয়ে সেভাবেই এগোতে লাগলাম৤ আমার রীতির পূর্ণ স্বচ্ছ যুক্তবর্ণই আমি তৈরি করলাম৤ সাধারণ চালু রীতির প্রথম প্রজন্মের যুক্তবর্ণ ব্যবহার করলাম না৤ তেমন করলে আর নতুন ফন্ট তৈরি করে কী হবে? 


          মাসের পর মাস গেল এভাবে৤ এক মনে লেগে রইলাম৤ অবশেষে মোটামুটি ব্যবহারযোগ্য একটি বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করতে পারলাম৤ একটা জিনিস দেখলাম যে অন্যদের মতো পুরানো পদ্ধতির যুক্তবর্ণ তৈরি না-করায় আমার ফন্টের আয়তন হল অনেক কম, মাত্র ৭৮ কেবি৤ অন্য ফন্টে দেখলাম ৩৫০ কেবি থেকে ৭০০ কেবি-র উপরে৤ পরিমার্জনের পরে আমার ফন্টের আয়তন দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৮ কেবির কম৤ এই ১০ কেবি বৃদ্ধি হয়েছে পরবর্তী কালে নানা সংযোজন, সংশোধন, পরিমার্জনের কারণে৤ আর অন্য ফন্টের চেয়ে এখানে ব্যবহারিক সুবিধা অনেক বেশি, নানা চিহ্ন বা সংকেত ব্যবহারের সুবিধা আছে, যা সাধারণত বাংলা ফন্টে পাওয়া যায় না৤ তা ‘বিবরণ’ ফাইল (AhanLipi-Bangla14 BIBARAN) থেকে দেখে নেওয়া যাবে৤ এই যে ১০ কেবি বাড়ল তার থেকে কিছু কমানো যেত, কিন্তু সে পথে যাইনি৤ ওটুকু থাক, কমাতে গিয়ে ভুল জায়গায় হাত পড়লে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া কঠিন হবে৤ 

          ফন্ট তৈরি হবার পরে তা দিয়ে লেখালিখি শুরু হল৤ নানা জায়গায় সে ফন্ট দিয়ে লিখে পাঠাতে লাগলাম৤ আমার নিজস্ব ব্লগ তৈরি করলাম অনেকগুলি(মোট প্রায় ২০টি), আর সেখানে লিখে চললাম৤ এতে দুটো কাজ হল, এক-- লেখালিখি হল অনেক, দুই-- ফন্টের ফিল্ড টেস্ট-- ক্ষেত্র পরীক্ষণ হল৤ যেখানে কিছু ত্রুটি পেয়েছি, বা পালটানো দরকার, পালটালে সুবিধে হবে বলে মনে হয়েছে, সেখানে তা পালটে ঠিক করে নিয়েছি৤ প্রতিনিয়ত এটা করেছি, এখনও করে চলেছি৤ সদ্য গত ০৪.০২.২০১৫ তারিখে কিবোর্ডের কিছুটা সম্মার্জন করা হয়েছে৤


          বাংলাভাষায় বিজ্ঞান পত্রিকা  ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকায় লিখলাম কেমন করে ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করতে হয় তা নিয়ে৤ যেসব কথা বহু কষ্ট করে খুঁজে নিয়ে, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে শিখলাম সেটা কেন লোকের কাছে হাট করে দেওয়া? তার মুখ্য কারণ হল, আমি চাই, অনেক মানুষ বাংলা ইউনিকোড ফন্ট তৈরি করুন, এতে বাংলা ফন্টের গুণমান যেমন বাড়বে, তেমনি বাংলা চর্চাও বাড়বে৤ বাংলা চর্চা বাড়াবার জন্যই তো এত শ্রম করা৤ তাই আমার সামান্য এই বিদ্যা অনুসারে একটি প্রবন্ধ লিখলাম ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকায়(জুলাই, আগস্ট, নভেম্বর ২০০৮)৤


          কয়েক বছর পরে ল্যান্ড লাইনে একটা ফোন পেলাম, নারী কণ্ঠ শুনে আমি বিরক্ত, হয়তো ইনসিওরেন্স বা ফিক্সড ডিপোজিটের কথা বলবে৤ হটিয়ে দেব ভাবছি, এমন সময় সেই নারী তাঁর নাম বললেন৤ জানতে চাইলাম কী ব্যাপার? তিনি আমার লেখাটি ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ পত্রিকায় পড়েছেন, তাই এব্যাপারে বিশদ জানতে আমার সঙ্গে কথা বলতে চান৤ আসতে বললাম৤ তাঁর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারলাম তিনি এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষক, বিবাহিত সংসারী নাম সুনন্দা মুখার্জি৤ 

সুনন্দা মুখার্জি

তাঁকে যতটা সম্ভব বিস্তারিত করে ফন্টের ব্যাপারটা বললাম৤ পরে লক্ষ করে দেখলাম যে, অনেকদিন ফন্ট নিয়ে নাড়াচাড়া না করায় অনেক কিছুই ভুলে গেছি৤ তাই আবার নতুন করে ফন্ট নিয়ে নাড়াচাড়া করলাম৤ অনেক সংশোধন সংযোজন সম্পাদনা করলাম, অনেকটা উন্নত করলাম৤ শ্রীমতী মুখার্জি আলোচনা করতে আসায় আমার লাভই হয়েছে৤ সে কথাটা তাঁকে আমি বলেওছি যে, আপনার সঙ্গে কথা বলায় আবার নতুন করে অনেক কিছু সংশোধন সংযোজন করলাম, ফিরে নাড়াচাড়া করলাম৤ আমার লাভই হয়েছে৤

          একটা জিনিস দেখে আমি খুব অবাক৤ কী সেটা? ফন্টের গঠন বিষয়ে নেটে যে শিক্ষা/লেসন মাইক্রোসফ্‌ট দিয়েছে, যার হাত ধরে, যেসব দেখে দেখে আমার কাজ কর্ম এগিয়েছে, সেখানে ঢুকে দেখি এবার আগেকার লেখালিখি এবং উদাহরণ তো ছিলই, নতুন অনেক সংযোজন হয়েছে, তার মধ্যে আমার স্টাইলে যুক্তবর্ণ লেখার শিক্ষাও আছে৤ এমন যে কেন তাঁরা করলেন তা আমার বোধগম্য হল না৤ তাঁরা কি আমার স্টাইলটাকে অনুমোদন করলেন? অথবা এমনিভাবেই তাঁরা করতে চান? যদি চান, তবুও আমার চিন্তাভাবনার সঙ্গে তাঁদের মিল প্রায় হুবহু, আর এমনিভাবে নিজেরাই করতে না চাইলে, তার মানে দাঁড়ায় আমার পথটি তাঁরা অনুমোদন করলেন৤ কারণ, যে উদাহরণ তাঁরা দেখিয়েছেন তা এমনি৤ 
মাইক্রোসফ্‌টের এই লিংকটির দিকে  দৃষ্টি আকর্ষণ করি--       


       
          আমি তো ঠিক এটাই লিখতে চাই৤ ক+্+দ ক্দ৤
       
          আর স+্+দ+্+ক স্ক্দ৤ 

          আমার ফন্টে  স্ক্দ্ম্গ  অর্থাৎ পাঁচটি অবধি বর্ণ পরস্পর যুক্ত করা যাবে৤ অবশ্য বাংলায় যুক্তবর্ণ হয়--  
(১)দুই বর্ণের সংযোগ, 
(২)তিন বর্ণের সংযোগ, 
(৩)চার বর্ণের সংযোগ৤ 

            চার বর্ণের চেয়ে বেশি বর্ণ নিয়ে সংযোগ বাংলায় হয় না৤ এগুলির উদাহরণ-- 
দুই বর্ণ ধাক্কা, খদ্দর, উল্লাস, সম্মান, স্মরণ; 
তিন বর্ণ উজ্জ্বল, স্প্লিট, রাষ্ট্র, নিষ্ক্বাথ;   
চার বর্ণ স্প্রিং, স্বাতন্ত্র্য, সৌক্ষ্ম্য৤

  
          পরে আরও একটা জিনিস দেখে উৎসাহিত হয়েছি৤ বাংলাদেশের একটি খবর৤ তা এমনি--
আমার বর্ণমালা নামে নতুন একটি বাংলা ফন্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প। এটাই হবে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে বানানো প্রথম ফন্ট। ইউনিকোড সমর্থিত নতুন এ ফন্ট তৈরির জন্য এই প্রতিষ্ঠান তিনটির মধ্যে গতকাল সোমবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি সমঝোতা চুক্তি হয়েছে।’(বাংলাদেশের সরকারি সাইট, আমার বর্ণমালা  ২১/১২/২০১২)৤ 

        অন্য এটি খবর--
        নতুন উদ্ভাবিত ব্যবহারিক প্রমিত বাংলা অভিধানের বিষয়ে জামিল চৌধুরী বলেন, বিশেষ করে যুক্তাক্ষরগুলো আমূল পাল্টে যাবে। নব উদ্ভাবিত অভিধানে প্রতিটি যুক্তাক্ষর আমরা স্পষ্ট দেখতে পাব। বর্তমানে অনেক যুক্তাক্ষর রয়েছে, যা কেবল অক্ষরটিই দেখে থাকি। তিনি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে বলেন, যেকোনো যুক্তাক্ষরের প্রথম অক্ষরটি ছোট এবং অপরটি তুলনামূলকভাবে একটু বড় হবে। ফলে শব্দ বিন্যাসে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে।(নেটের সাইটের নাম--‘পিপীলিকাpipilika এখানে কোনও সাল তরিখ দেওয়া নেই)৤   

        অন্য আর একটি খবরে একই সংবাদ--
        নতুন উদ্ভাবিত ব্যবহারিক প্রমিত বাংলা অভিধানের বিষয়ে জামিল চৌধুরী বলেন, বিশেষ করে যুক্তাক্ষরগুলো আমূল পাল্টে যাবে। নব উদ্ভাবিত অভিধানে প্রতিটি যুক্তাক্ষর আমরা স্পষ্ট দেখতে পাব। বর্তমানে অনেক যুক্তাক্ষর রয়েছে, যা কেবল অক্ষরটিই দেখে থাকি। তিনি পাণ্ডুলিপি দেখিয়ে বলেন, যেকোনো যুক্তাক্ষরের প্রথম অক্ষরটি ছোট এবং অপরটি তুলনামূলকভাবে একটু বড় হবে। ফলে শব্দ বিন্যাসে সৌন্দর্য বৃদ্ধি পাবে। প্রায় ছয় বছর ধরে এই অভিধানের কাজ চলছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একসেস টু ইনফরমেশনপ্রকল্পের প্রায় ২ হাজার অভিধানের কাজ বাস্তবায়ন করছে বাংলা একাডেমী।(হলিউড বাংলা ব্লগ৤ হলিউড থেকে প্রকাশিত অনলাইন বাংলা পত্রিকা৤ February 24, 2013, 5:02 AM )





পরবর্তী ৫ম অংশ দেখুন:

http://banglamagna.blogspot.in/2015/02/blog-post_82.html




সংশোধন, সম্পাদন, সংযোজন চলছে
সর্বশেষ পরিমার্জন ২৯/০৪/২০১৬




No comments:

Post a Comment