লেখাটি ‘অহনলিপি-বাংলা১৪’AhanLipi-Bangla14 ফন্টে
পড়তে হবে
ঠিক ঠিক পড়তে হলে সংগে দেওয়া লিংক থেকে ফন্ট ফ্রি ডাউনলোড করে নিতে হবে
ইউনিকোড ফন্ট ডাউনলোড করার লিংক উপরে দেওয়া হল
লিংকে ক্লিক করুন ফন্ট ডাউনলোড হবে
যুক্তবর্ণ সরল গঠনের
বুঝতে লিখতে পড়তে সহজ
========================
ঐকতান গবেষণা পত্র, ৩৯ বর্ষ ১৪১৬ বঙ্গাব্দ, ২০০৯-১০ খ্রিঃ
প্রকাশিত নিবন্ধ
বাঙালির অস্তিত্বের সংকট
প্রসঙ্গত:
"বাঙালিয়ানা-- একটি নিন্দনীয় ঝোঁক"
মনোজকুমার দ. গিরিশ
আমাদের এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হল, বাঙালিয়ানা-- একটি নিন্দনীয় ঝোঁক এতে কেউ খুশি হবেন, কেউ দুঃখ পাবেন খুশি এই কারণে যে, বাঙালিরা বঙ্গীয়জাতিসত্ত্বার ক্ষুদ্র গণ্ডী ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে আসতে পেরেছে সারা পৃথিবীর মানুষকেই তারা এক মনে করছে এক জাতি না হোক, এক ভাষা না হোক, অন্যকে আপন মনে করার একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছে যাঁরা দুঃখ পাচ্ছেন-- তাঁদের দুঃখ এই কারণে যে, বাঙালিরা নিজের সংস্কৃতি, ভাষা, নিজের ইতিহাস, নিজের উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের বৈশিষ্ট্য ভুলে যাচ্ছে দুঃখ পাচ্ছে, তরুণেরা(এবং অবশ্যই তরুণীরাও) নিজের ভাষার গান শুনতে চায় না শুনবে কেন? এটা একটা ব্যাক্ডেটেড ব্যাপার কোনও তরুণ একালে এফএম-এ বাংলা গান শুনছে এটা এখন প্রায় এক হাস্যকর ব্যাপার বন্ধুরা তাকে দুয়ো দেবে, উপহাস করবে তার চেয়েও বড় কথা হল, এফএম-এ বাংলা গানই তো হয় না! কে বললে হয় না? ঠেকনো দেবার জন্য দু-একটা তো হয়ই!
এরা বাংলা গান শুনবে না, কিন্তু এরা তবে কী গান শুনবে? ইংরেজি গান? শতকরা পাঁচজনও তা শুনবে না, ইংরেজি গান শোনায় যে এলেম লাগে তা এদের নেই-- তৈরি হয়নি তাই এরা অবশ্যই হিন্দি গান শুনবে বাংলা গান শুনতে যে মানসিক প্রস্তুতি দরকার, একটুও আর অবশেষ নেই তার বাংলা গান শুনতে যে উন্নত সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের দরকার হয়, তা এদের প্রায় কারওই নেই, সারাটা দেশ থেকেই তো সেসব প্রায় উবে গেছে সুতরাং বাকি থাকে হিন্দি গান হিন্দি গান শুনতে না পেলে এরা খুবই অসহায় বোধ করে, জীবনটা যেন কেমন আনুনি, জোলো জোলো বিস্বাদ মনে হয় সে গান এত জনপ্রিয় আর নির্ভরযোগ্য এবং নির্ভার যে, তা যে-কোনও একপ্রকার শব্দ হলেই চলে যায় কানের কাছে খসর ঘসর, খচর ঘচর ধরনের একটা শব্দ হলেই কাজ চলে
সুতরাং এখন গান একটাই শব্দ Gun, আর তাতেই আপ্লুত সবাই-- কোমর, পেট, মাথা, বুক, মুখ, শরীর দুলিয়ে হল্লার এমন সুযোগ তো বাংলা গানে নেই তবে এদের দুঃখের বোধ হয় অবসান হতে চলেছে বাংলা গানেও একই প্রকার খসর ঘসর, খচর ঘচর শুরু হয়েছে একটি ধর্মীয় গানের ধৃষ্ট বাংলা ফিলমি সংস্করণ সম্প্রতি প্রচারিত হয়ওয়ায় তা গৌরাঙ্গধাম নবদ্বীপের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান থেকে আপত্তির মুখে পড়েছে, কিন্তু তা বন্ধ হয়নি, বরং তা প্রায় সর্বত্র পরম সুখে গদ গদ গাওয়া চলছে, ভজ ভজ শোনা চলছে
(২)
এসব আর নতুন করে বলতে, শুনতে ভালো লাগছে না একটি বিদেশি ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমীক্ষায় নাকি বলা হয়েছে, এই শতাব্দীর শেষে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হবে সংবাদপত্রে চিঠি দেখেছি যে, ’এক জার্মান সমীক্ষায় বলা হয়েছে, এই শতকের শেষে বাংলা ভাষা বিলুপ্ত হতে চলেছে‘ [চিঠি, কল-২৯ থেকে রমা মুখার্জি, দৈনিক স্টেটসম্যান, ৪ আগস্ট, ২০০৬ শুক্রবার, পৃঃ-৪] আর ব্রিটিশ সমীক্ষায় বলা হয়েছে, ”বাংলা বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাষা হলেও, এবং ভাষার দাবিতে বাংলাভাষীরা একটি রক্তক্ষয়ী রাজনৈতিক সংগ্রাম করলেও বাংলাভাষার প্রভাব বিস্ময়কর রকমের কম...বাংলাভাষীরা বেশিরভাগই দ্বি অথবা ত্রিভাষী এবং সর্বদাই নিজের ভাষাকে অগ্রাধিকারের তালিকায় দুই বা তিন নম্বরে রাখে...যার ফলে বিপুল জমি খেয়ে যাচ্ছে হিন্দি কাজের ভাষা হয়ে ওঠার তাগিদ বাংলার কমই চিরকাল ইংরেজি নির্ভরতা বেশি এখন নতুন করে আর তো সম্ভব নয় ফলে বাড়বে তো না-ই, বাংলা ক্ষইবে“ (বিশ্বের ভাষাচিত্র : একটি পর্যবেক্ষণ, ’তবু বাংলার মুখ‘ চতুর্থ বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ত্রৈমাসিক, মাঘ ১৪১১, জানুয়ারি ২০০৫, পৃঃ ১৫) এসব বিদেশি সমীক্ষা হয়তো সবটা অমূলক নয়, তার উদাহরণ তো ঘাটে পথে সব সময়েই পাওয়া যায় সমীক্ষাগুলি মোক্ষমই বটে বোধহয় শতাব্দী আর পুরবে না বাংলাভাষাটা তার আগেই ইহকালের পাট চুকিয়ে ফেলবে-- রোগলক্ষণ দেখে, শ্বাস ওঠা দেখে তেমনই তো মনে হচ্ছে
এখন বাংলায় প্রায় ২৩টা ’বাংলা‘ চ্যানেল আছে, সেখানে সত্যিকারের বাংলা ভাষার চ্যানেল ক‘টা আছে, তা বোঝা মুশকিল প্রায় সব চ্যানেলেই হিন্দি অনুষ্ঠানের ছড়াছড়ি আবার অনেক চ্যানেলেই দাদারা শিশুদের নিয়ে কত কাণ্ড করছেন, যার প্রধান ভাষাটাই হিন্দি দ্বিতীয় প্রধান ভাষা হল ইংরেজি, আর বাংলাটা সেখানে ”সর্বদাই নিজের ভাষাকে অগ্রাধিকারের তালিকায় দুই বা তিন নম্বরে রাখে“ কথাটার এমন জবরদস্ত প্রমাণ আর কী হতে পারে? এসব অনুষ্ঠান দেখে মনে হয়-- বাঙালিরা হিন্দিতে কতটা দক্ষ হয়ে উঠেছে এযেন, তার পরীক্ষা নেওয়া চলছে সিনেমার ছবি দেখিয়ে সে সম্পর্কে প্রশ্ন করা হয় আর সেসব ছবির প্রায় ১০০ ভাগই হিন্দি ছবি! দূরদর্শনে বাংলা সংবাদ অকারণ হিন্দি অনুবাদে ভরিয়ে ফেলা হচ্ছে মনে হতে পারে, সংবাদ নয়, এ হল হিন্দি-অনুবাদ শিক্ষার আসর!
ভাষার যে এক অসীম অর্থনৈতিক গুরুত্ব আছে, সে কথা আমরা ভুলে বসে আছি ”ভাষার যে কী অসীম অর্থনৈতিক এবং সামাজিক গুরুত্ব, তা যত দিন না বঙ্গভাষীরা বুঝবেন, তত দিন বাংলা চালু হবে না“(প্রিয় সম্পাদক, আজকাল, ৯আগস্ট, ২০০৭) শুধুমাত্র বাংলা গান শুনলেও যে বাঙালির অর্থনৈতিক সুবিধা বাড়ে, সে কথাটি যতদিন না আমরা বুঝব, ততোদিন বাংলার আর্থিক মেরুদণ্ড শক্ত হবে না আর ঠিক সে-কারণেই আর্থিক ক্ষেত্রে আমরা মেরুদণ্ডহীন প্রাণী!
ভাষার সঙ্গে আর্থিক সম্পর্ক যে নিবিড় তা, সহজে বুঝতে অসুবিধে হলে এটা
(৩)
তো বোঝা সহজ যে, বাঙালির প্রতিষ্ঠান থেকে জিনিসপত্র কিনলে তাদের ব্যবসায়ের কিছু সুরাহা হয় বাঙালির দোকান থেকে কেনো, এ কথাটা বললে আন্তর্জাতিক বাঙালিদের বিবমিষার উদ্রেক হবে আর বাঙালির অধঃপতনের সেটাই কারণ যদি অধঃপাত পাতালপ্রবেশ অবধি না-পৌঁছাতে চাওয়া হয়, তবে আমাদের প্রয়োজনীয় সকল দ্রব্য বাঙালির দোকান, প্রতিষ্ঠান থেকে কিনতে হবে আমাদের ছেলেমেয়ে পরিজন বাণিজ্যে বাঁচুক এটা আশা করি আমরা চাই নয়তো, এভাবে ভূমিতলে কৃমিকীটের মতো আর কতকাল? ১৯৬১-তে ছিল রবীন্দ্র শতজয়ন্তী, তখন সিদ্ধান্ত হয়েছিল পঃবাংলার সব কাজ বাংলায় হবে সে সিদ্ধান্তটা অনেক আগেই বরফ হয়ে জমে গেছে, গলাবার কোনও প্রয়াসই নেই এখন সেটা বরফের চেয়ে কঠিনতর কিছু হবার অপেক্ষায় আছে হয়তো!
সিকি শতক পেরোনো দাবি--’সরকারি কাজে সকল স্তরে বাংলা চালু করতে হবে এবং অবিলম্বে-- এটাই আমাদের দাবি‘(সত্যযুগ, ২/১১/১৯৭৯) ৩০ বছর
সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পঃবঙ্গের সকল স্কুলে বাংলা বাধ্যতামূলক করার দাবি করেছিলেন কিন্তু ”প্রশাসনিক বিষয় রয়েছে“ বলে প্রশাসন জানিয়েছেন এপ্রসঙ্গে একটি মজার কথা মনে পড়ল, ডিশ এ্যান্টেনার মাধ্যমে
টিভি দেখার এক অতি আধুনিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে, সেখানে অনেক চ্যানেল দেখা যায় ডিশ সুবিধার সেই চ্যানেলের অরণ্যে পঃবাংলাতেই বাংলাভাষা ’আঞ্চলিক‘তাই অঙ্গুলিমেয় গোটা কয়েক মাত্র বাংলা চ্যানেল তাতে দেখা যায়, অথচ এখন বাংলায় আছে প্রায় ২৩টা চ্যানেল আর এই ”আঞ্চলিকতার“ ফেরে অতি অল্পসংখ্যক বাংলা চ্যানেল দেখা যাওয়াতে তারা সংবাদ ইত্যাদি যা প্রচার করে তা নিতান্ত একমাত্রিক হতে বাধ্য সঠিক নিরপেক্ষ সংবাদটি পেতেও তাই এই ক‘টি মাত্র চ্যানেল তেমন সাহায্য করে না
দুঃখ পাওয়ার কিছু নেই, পৃথিবীতে কোনও কিছুই অক্ষয় নয়, বরং বাংলা ভাষার অবসানে বাঙালির বিখ্যাত চর্বি কমার সুলক্ষণ দেখা দিয়েছে বাংলা গান মানে তো মিনমিনে পিনপিনে ব্যাপার(উদ্দণ্ড সংগীতওয়ালা মুম্বই জনতার এমনই ধারণা) তবে এখন তা আর মিনমিনে ব্যাপার রইলো না, বাংলা গানই রইলো না! এখন থেকে গানের সাথে উদ্দাম উন্মত্ত নৃত্যের সুবিধে হয়ে গেল চর্বির ক্ষয় সুনিশ্চিত বাত অম্বল আর ধরবে না
একটা ব্যাপার লক্ষ্য করার মতো, বাংলা চ্যানেলগুলিতে এত এত হিন্দি বিজ্ঞাপন হয় কেন? আজকাল কি হিন্দিভাষীরা সকলে বাংলা চ্যানেল দেখছেন? নাকি হিন্দি-ব্যবসায়ীরা এক ঢিলে দুই পাখি মারছেন? পণ্যের প্রচারও হচ্ছে এবং হিন্দির প্রসারও ঘটছে! ”দেশপ্রেম“ তাঁদের একাজে উদ্বুদ্ধ করেছে?
বহুকাল আগে থেকেই লোকে, বিশেষ করে কবিরা বাংলার দুরবস্থা নিয়ে আক্ষেপ করে গেছেন, তাঁদের সে আক্ষেপ আর করতে হবে না যে নেই আদৌ, তাকে নিয়ে আক্ষেপ করে কী হবে? বাঙালিরা চিরকালই নিজের ভাষাকে তেমন
(৪)
করে গুরুত্ব দেয়নি, তারা নিজের ভাষাকে অবজ্ঞা অবহেলা করেই এসেছে অবজ্ঞা অবহেলা যে কতটা তা বোঝা যাবে প্রাচীন কবি আবদুল হাকিম (১৬২০-১৬৯০ খ্রিঃ)-এর ক্ষোভ থেকে__
জে সবে বঙ্গেত জর্ম্মি হিংসে বঙ্গবানি
সে সব কাহার জর্ম্ম নির্ণএ না জানি
দেসি ভাষা বিদ্যা জার মনে না যুয়াএ
নিজ দেস ত্যাগি কেন বিদেসে না জাএ
__ নুরনামা [সপ্তদশ শতাব্দী]
(আমাদের মাতৃভাষা-চেতনা ও ভাষা আন্দোলন-সম্পাদনা,মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, পৃঃ-২১)
একথার পরিপ্রক্ষিতে এখন বলতে হয়, যারা ’হিংসে বঙ্গবানি‘ তাদের আর বৈদেশ যাবার দরকার নাই গো, ’বঙ্গবানি‘ই এখন বৈদেশে বিতাড়িত আর শুধু বৈদেশই নয়, একেবারে ইন্তেকাল করেছেন তাই বড় নিশ্চিন্দি
একটা কথা আছে--
কে কারে মারিতে পারে, কে-বা কার অরি,
সবারে সংহারি আমি, সব আমি করি
আমরাই সংহার করেছি, আমরাই সব করেছি আমরা বাংলা ভাষাকে কোনও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণ দেইনি, কোনও অর্থনৈতিক পৃষ্ঠপোষণ দেইনি
প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল জনপ্রতি বার্ষিক একটাকা হারে বাংলাভাষার জন্য বছরের বাজেট করা হোক ৮কোটি টাকা কেন্দ্রীয় সরকারের কোন্ দপ্তর সে বাজেট করবে? রাজ্য সরকারের কোন্ দপ্তর সে বাজেট করবে? যেহেতু সরকারি কাজে ব্যবহারে বাংলাভাষা অবহেলিত থেকে গেছে, সে জন্য প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, বাংলাভাষার জন্য একটি পূর্ণ মন্ত্রক করা হোক সরকার কখনও সাধারণ মানুষের কথায় কান দেয় না, মন্ত্রীরা নিজেরা যেটা চান, সেটাই হয়, তাই এসবের কিছুই গৃহীত হয়নি, কোনও উদ্যোগই নেওয়া হয়নি ভ্যালা গঙ্গারাম সাধারণ মানুষ কিছুটা সাংস্কৃতিক পৃষ্ঠপোষণ দেওয়ায় এতদিন বাংলাভাষা ডালভাতেই বেশ কাটিয়ে দিয়েছে ভালোভাবেই কাটিয়েছে কিন্তু তা এত ঠুনকো, তথা ডেলো-- (ডাইল থেকে ডেলো!) যে, আঘাত লেগেছে যেই অমনি সে তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে ”ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার হিন্দির জন্য যে পরিমাণ অর্থ প্রতি বছর বাজেটে বরাদ্দ রাখে(প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ), বাংলা ভাষার জন্য ঠিক সেই পরিমাণ(প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ) অর্থ প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকারের বাজেটে বরাদ্দ রাখতে হবে“কেন্দ্রীয় সরকারের কোন্ দপ্তর সে বাজেট করবে?
ভারতে বাংলাভাষীর সংখ্যা ৮ কোটি মাথাপিছু বছরে অন্তত এক টাকা করে পশ্চিমবঙ্গের সরকারি বাজেটে প্রতি বছর বাংলা ভাষার জন্য বাজেট-বরাদ্দ হিসেবে ৮ কোটি টাকা রাখা যাবে না কেন! বাংলা ভাষার বিকাশ, উন্নয়ন, প্রসার, প্রচার এবং বিজ্ঞান, বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও বিশেষভাবে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে বংলা
(৫)
প্রয়োগের ব্যাপারে দেখাশোনা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গে একটি আলাদা মন্ত্রক ও পূর্ণমন্ত্রীই-বা থাকবে না কেন?“(প্রিয় সম্পাদক, আজকাল, ২৫অক্টোবর,২০০৭)
অক্টোবর মাসের ১ তারিখ ছিল বৃহস্পতিবার(২০০৯),সেদিন রাত পৌনে
দশটা নাগাদ বাংলা চ্যানেল দেখছিলাম, একটিতে দেখি হিন্দি গান হচ্ছে, সেটি ছেড়ে পরের বাংলা চ্যানেলটি ধরলাম, দেখি সেখানেও হিন্দি গান হচ্ছে, তাই সেটি ছেড়ে পরের বাংলা চ্যানেলে গেলাম, সেখানেও তখন হিন্দি গান হচ্ছে!
আরকতটা আমরা প্রভুভক্ত হয়েছি তা বুঝবার জন্য আর একটি বাংলা চ্যানেল ধরলাম, আশ্চর্য যে, সেখানেও হিন্দি গান হচ্ছে৻ পর পর চারটা ”বাংলা“ চ্যানেলের হিন্দি ভক্তি দেখে আমি অত্যন্ত অভিভূত সব কটিতেই সংগীত প্রতিযোগিতা হচ্ছিল আর কটায় এহেন পূজাপাঠ হচ্ছে দেখার জন্য পর পর খুঁজলাম, এবং মোটেই ব্যর্থ হলাম না আরও দুটো চ্যানেলে হিন্দি সিনেমা চলছে এরা ’বাংলা‘ চ্যানেল নাম নিয়ে কেন লোককে প্রতারণা করছে? হিন্দি গান, সিনেমা-ই যদি হবে, তাহলে সেটা হিন্দি চ্যানেলই হোক না কি অন্য কোনও ব্যাপার আছে এর পিছনে? ’বাংলা‘ চ্যানেল বলব, অথচ বাংলা অনুষ্ঠান কম করব রহস্যটা কী? শিরোনামের ”বাংলা“ কথাটা কি কেবলই বিজ্ঞাপন ?
দুঃখ করে কাজ কী রে ভাই আমরা সবাই(স-ব--- সব ভাই)এতই ’আন্তর্জাতিক‘ যে নিজের ভাষাকেও পর বানিয়ে ছেড়েছি শেষে দূর করে দিয়েছি (এক বড় রাজনীতিক নেতা দিয়েছেন অবঙ্গ অন্য একটি ভাষা শেখার পরামর্শ, আর অন্য এক রাজনীতিক নেতাও আবার ভিন্ন আর একটি ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবি করেছেন পশ্চিমবঙ্গের প্রশাসনে বাংলা যে চালুই করা যায়নি (বা চালু করা হয়নি!), সে ব্যাপারে মাথা ঘামাবার কেউই সময় পাচ্ছেন না ডান হোন, কিংবা বাম অথবা মধ্য-- এ ব্যাপারে কোনও আলাদা হেলদোল দেখা যায় না জল নড়ে না, সবাই বেশ নিশ্চিন্দি আছেন!) বাংলা না হলেও কাজ কোথাও আটকায় না, না তা লেখাপড়া, না চাকুরি, না জীবিকা অর্জনের কোনও পথ, মেলামেশা, বিনোদন বা অন্য কোনও কিছু, কোত্থাও আটকায় না বাংলা ভাষাটা বাঙালির লাগে কোন্ কাজে? এটা যে হবারই ছিল তা আমরা নির্বোধেরা কিছুকাল আগেও অবধি বুঝতে পারি নি ছিঃ!
যখন বুঝলাম তখন কিছু আর করার প্রায় রইলো না এই ভবিষ্যৎ বাণীই এক সহমর্মী মহিলা(কৃষ্ণা রায়) বছর তিরিশেক আগে করেছিলেন-- বলেছিলেন, ’তখন বাঙালি বুঝবে‘সত্যিই কি বুঝবে?যার কিছুই হারায় নি, বরং আনন্দদাসত্ব আরও বৃদ্ধি পেয়েছে,তার বোঝার কি আর কিছু আছে?বোঝার তার দরকারটা কী? গলায় শেকলের দাগ থাকলে তাতে কি আসে যায়, পেট পুরে খাওয়া পরা তো চলছে, আরাম আয়েস হচ্ছে তবে?
বুনো কুকুর ঠিক মতো খেতে পায় না, দিনে লোকালয়ে আসতে পারে না, স্বাধীনতার কী কষ্ট! কষ্টে কাজ কী রে ভাই, যদি দরকার না থাকে স্বাধীনতাটাই?
(৬)
সে অচেনা প্রাচীন যুগের আবদুল হাকিম কেন, এযুগে রবীন্দ্রনাথও একই সুরে কথা বলে গেছেন, কিন্তু কেউ যে নড়ে না, কিছুই যে নড়ে না রবীন্দ্রনাথ বরং আরও বেশি বিপজ্জনক কথা বলে গেছেন, তিনি বলেছেন, ’আমার বেশ মনে আছে অনেকদিন পূর্বে একজন বিশেষ বুদ্ধিমান শিক্ষিত ব্যক্তি আমাকে বলিয়াছিলেন, ”বাংলা সাহিত্য যতই উন্নতিলাভ করিতেছে ততোই তাহা আমাদের জাতীয় মিলনের পক্ষে অন্তরায় হইয়া উঠিতেছে কারণ এ সাহিত্য যদি শ্রেষ্ঠতা লাভ করে তবে ইহা মরিতে চাহিবে না__ এবং ইহাকে অবলম্বন করিয়া শেষ পর্যন্ত বাংলাভাষা মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া থাকিবে এমন অবস্থায় ভারতবর্ষে ভাষার ঐক্যসাধনেরপক্ষে সর্বাপেক্ষা বাধা দিবে বাংলা ভাষা অতএব বাংলা সাহিত্যের উন্নতি ভারতবর্ষের পক্ষে মঙ্গলকর নহে“‘
[রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ১৩১৮/(১৯১১/১২), পৃঃ-৬০৫, খণ্ড-৯, রবীন্দ্ররচনাবলী(সুলভ সংস্করণ) ১২৫তম রবীন্দ্রজয়ন্তী উপলক্ষে প্রকাশিত, ভাদ্র ১৩৯৪, শক ১৯০৯] উল্লেখ্য যে নোবেল পুরস্কার পাবার আগে তিনি একথা বলেছেন তিনি নোবেল পান ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দের শেষ দিকে ১৩ নভেম্বর নির্বাণোন্মুখ বাংলাভাষার দীপশিখা শেষবারের মতো হয়তো সে-ই অতি তীব্রভাবে জ্বলে উঠেছিল?
আর বাংলাভাষার উন্নতি যে অন্য ভাষারও পক্ষে ”মঙ্গলকর নহে“ তার একটু হদিস পাই অন্য একটি বক্তব্য থেকে ”ললিতমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ’টিচিং অব ইংলিশ‘ বিষয়ে একটি গবেষণাপত্র পাঠ করেন... বর্তমানকালের ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ভুল ইংরেজি জ্ঞানের জন্য মাতৃভাষা, বিশেষ করে বাংলাভাষার উন্নতিকেও কিছুটা পরিমাণে দায়ী করা যায় ত্রিশ বছর আগে বাংলায় শিশুসাহিত্য বলে কিছু ছিল না এবং শিশুরা আনন্দের জন্য ইংরেজি গল্প পড়ত এখন বাংলাভাষার বিকাশ হয়েছে কিন্তু একদিকে লাভ হলেও অন্যদিকে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে“ __ দৈনিক স্টেটসম্যান ৪ আগস্ট ২০০৬, শুক্রবার,[দি স্টেটসম্যান, শতবর্ষ আগে, ৪ আগস্ট ১৯০৬]
নোবেল পাওয়া বিশ্বজয়ী একটি ভাষা শেষ অবধি মুছে যাবে? সে জন্য কি নোবেলটাই আগে হারিয়েছে, নোবেল লজ্জায় মুখ ঢেকেছে? ভারতের দ্বিতীয় জনগরিষ্ঠ মাতৃভাষা বাংলা,এটা নাকি পৃথিবীর চতুর্থ জনগরিষ্ঠ মাতৃভাষাও, এবং মধুরতম ভাষাক‘টির একটিও থাক গে ওসব, এত তথ্যে কাজ নেই ঘি খাওয়ার পয়সা নেই, কোনও এককালে ঘি খেয়ে কতকাল আর হাত শুঁকবে হে?
জনসংখ্যাটা কি ফ্যালনা? আরে সেটাই তো এতক্ষণ আলোচনা করা হল, সংখ্যাটা মিশে যাবে প্রভুর পদে আ--পদ যাবে৻
না, বাংলা নিয়ে আশা ভরসার সবটা অন্তত অন্ধকার নয় স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় যা বলেছেন তা অবশ্যই বাংলাভাষীদের প্রবলভাবে উৎসাহিত করবে, উদ্দীপিত করবে, প্রতিজ্ঞায় অটল করবে বাংলা ভাষার উন্নয়নে বাংলার বাঘ,স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয় যে কতটা আবেগপূর্ণ ছিলেন তা পড়লে
(৭)
অবাক হয়ে যেতে হয় এব্যাপারে তিনি যে দুর্মর আশা প্রকাশ করেছিলেন তা শ্রদ্ধায় স্মরণ করা যাক তিনি বলেছেন_”যদি এমনভাবে বঙ্গভাষার সম্পদ বৃদ্ধি করা যায় যে, সম্পূর্ণরূপে মানুষ হইতে হইলে অপরাপর ভাষার ন্যায় বঙ্গভাষাও শিখিতে হয়, এবং না শিখিলে অনেক অবশ্যজ্ঞাতব্য বিষয় চিরকালের মত অজ্ঞাত থাকিয়া যায় ও অন্য শত ভাষা শিক্ষা করিয়াও পুরা মানুষ হওয়া না যায়, তবেই বঙ্গভাষা জগতে চিরস্থায়িনী হইবে; বাঙ্গলার ভাষা জগতের অন্যান্য প্রধানতম ভাষার শ্রেণীতে সমুন্নীত হইবেঅন্যথা বঙ্গের তথা ভঙ্গভাষার গৌরব বাড়িল কৈ? বঙ্গসাহিত্য বলিলেই যাহাতে একটা বিরাট সাহিত্য বুঝায়, বিশ্বের অন্যতম প্রধান সাহিত্য বুঝায়, এমনভাবে বঙ্গসাহিত্যের গঠন করিতে হইবে“ (আনন্দসঙ্গী-আঃবাঃ পত্রিকা সংকলন,পৃঃ-২৪৫) তাঁর এ আশাটির কথা রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার পাবার আগের বক্তৃতাভারতের শ্রেষ্ঠভাষা বাংলা_ রবীন্দ্রনাথের ভাষা বাংলা_আমাদের অনবধানতায় যেন তা প্রান্তিক হয়ে না ওঠে
”নোবেল পুরস্কার প্রাপ্ত ভারতের শ্রেষ্ঠভাষা হল বাংলা এবং ভারতের মধুরতম ভাষাও ভাবপ্রকাশে দক্ষ ও সাবলীল এই ভাষারই ঘরের কবি হলেন মহাকবি রবীন্দ্রনাথ তাঁর রচনার দীপ্তিতে ভারতের আকাশ উজ্জ্বল হয়েছে নোবেল পুরস্কারের আলোতে ভারতের দ্বিতীয় জনগরিষ্ঠ ভাষা হল বাংলা আর জনসংখ্যায় বিশ্বে তা চতুর্থ চিনা, ইংরেজি, স্প্যানিশের পরেই বাংলার স্থান শতবর্ষ পূর্বেই বাংলা ভাষায় এসেছে সাহিত্যের নোবেল পুরস্কার, কিন্তু সেখানেই তার অগ্রগমন থেমে নেই দিন দিন তার প্রকাশ ক্ষমতা বেড়েই চলেছে, নতুন নতুন মৌলিক শব্দ সৃষ্টি হচ্ছে কারণ দুটি দেশে এখন বাংলাভাষার মৌলিক চর্চা হয় আর বন্ধুত্বপূর্ণ সহযোগিতার মাধ্যমে বাংলাভাষা অতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশে বাংলাভাষার মাধ্যমে রাষ্ট্রশাসন হয়, ফলে অতি দ্রুত বাংলায় প্রশাসনিক শব্দ বাড়ছে সেদেশের এবং এদেশের নানা মৌলিক গবেষণা বাংলাকে দিনে দিনে সমৃদ্ধতর করছে বাংলা ভাগ হয়ে মানুষের দুঃখ কষ্ট গেছে অনেকই, কিন্তু বাংলা ভাষার পক্ষে বিশাল লাভই হয়েছে এখন বাংলাদেশ এমন কম্পিউটার সফ্টওয়্যার তৈরি করেছে যে, লিখে দিলে সে কথা কম্পিউটার উচ্চারণ করে শোনাবে যন্ত্র এখন বাংলা কথা বলছে, নিজেই বলছে এর পরে এমন দিন শীঘ্র আসবে যখন ইমেল পাঠালে যন্ত্র পড়ে শোনাবে কী বার্তা পাঠানো হল আর তা বাংলা ভাষাতেই! রবীন্দ্ররচনা পাঠ করে শোনাবে, রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে শোনাবে, তার জন্য সিডি/ডিভিডি দরকার নেই বাংলাভাষা এগোচ্ছে, দ্রুত এগোচ্ছে আসুন এপারে আমরাও লেগে পড়ি এমনিতর নতুন নতুন গতিময় কাজে আমরা আর কেন বসে রই আলস করে?
কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর নানা দপ্তরে ”হিন্দি পক্ষ“ পালন করেনঠিক একইভাবে প্রতি বছর কেন্দ্রীয় সরকার নানা দপ্তরে ”বাংলা পক্ষ“ পালন করুন
ভারতের শ্রেষ্ঠভাষা বাংলার গৌরবে সকলে ভূষিত হোনকেন্দ্রীয় সরকারের
(৮)
তথ্য ও সম্প্রচার দপ্তরের রাষ্ট্রমন্ত্রী বাঙালি তিনি নিজে উদ্যোগ নিলে বিষয়টি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হতে পারবেরাজ্য সরকারও তেমনি ”বাংলা পক্ষ“ পালন করুন“(চিঠিপত্র, গণশক্তি, ৪/১০/২০০৯)
সংখ্যা নিয়ে একটা অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করা গেছে হিন্দি ছিল ২৮% শতাংশের কিছু বেশি মানুষের ভাষা(১৯৬১, ১৯৭১), পরে তা একটি জনগণনার পরে বেড়ে দাঁড়াল ৩৮ শতাংশের কিছু বেশি?(পরে ২০০১-এ তা দাঁড়িয়েছে ৪১%শতাংশের উপর?) যে জনগণনা থেকে হিন্দিভাষী মানুষ বিপুলভাবে বাড়তে লাগলেন ঠিক সেই জনগণনায় ভারতের বেশিরভাগ ভাষাভাষীর সংখ্যা কিন্তু কমে গেছে, বা অতি সামান্য বেড়েছে এমনকি যে বাংলাভাষীদের সম্পর্কে বলা হয় যে, এখানে ’বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ‘ হচ্ছে প্রতিনিয়ত, সেই বাংলাভাষীরাও বেড়েছে খুবই কম ’বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ‘ না হলে বোধ হয় তাদের সংখ্যাও কমেই যেত!
হঠাৎ এই বৃদ্ধি কীসের লক্ষণ? কোনও ভয় কি কাজ করছে মনে? তাই যতটা পারা যায় বাড়তে থাকুক সংখ্যার নানা মারপ্যাঁচে? বাংলাকেও নাকি এককালে বলা হয়েছে মিঠিবুলি হিন্দি চমৎকার! তাহলে,বাংলার পক্ষে হিন্দি তো বাজারিবুলি বাংলা বাংলাই তো তা হলে ভারতের তথাকথিত ”রাষ্ট্রভাষা“ হওয়া উচিত কটুবুলির বদলে মিঠিবুলিই তো ব্যবহার্য, তাই নয় কি? তা ছাড়া, বাংলা লিপির গঠন, সংখ্যার গঠন তো নাগরির চেয়ে বেশি নান্দনিক
’হিন্দি চাপানো হবে না‘ শিরোনামে সমাচার প্রচারিত একটি সংবাদে বলা হয়েছে, ”কোচিন, ২৪ সেপ্টেম্বর [১৯৭৭]--অহিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতে জোর করে হিন্দি চাপানো হবে না একথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রী মোরারজী দেশাই ... তিনি বলেন, বেশি বেশি ভাষা জানা বেশ ভাল কাজ ভারত একটি বিরাট দেশ এখানে মানুষেরা বহু ভাষায় কথা বলে ভারতের ৬০ শতাংশ মানুষ হিন্দিতে কথা
বলে হিন্দি নিয়ে কেরলে কোন বিবাদ কিংবা বিসংবাদ নেই“-সমাচার (সত্যযুগ, ২৫/০৯/১৯৭৭)
সংবাদপত্র ’যুগান্তর‘(বর্তমানে চালু নেই), থেকে কিছু সংবাদ উদ্ধার করা যাক, ’...ডাঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ তাঁহার বক্তৃতায় আরও বলেন-- সরকারী চাকুরিয়াদের হিন্দি আয়ত্তের উপর তাহাদের উন্নতি নির্ভর করা উচিত এই ব্যবস্থার ফলে হিন্দী যোগ্য আসন লাভ করিবে
’... ভারতের অন্য যে কোন ভাষা অপেক্ষা হিন্দী কমসংখ্যক লোককে শিখিতে হইবে বলিয়া হিন্দীকে রাষ্ট্রভাষা করা স্থির হয় ভারতের অন্যান্য ভাষা অপেক্ষা হিন্দী শ্রেষ্ঠ বলিয়া এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় নাই‘ [যুগান্তর, ২৮জুন,১৯৫৫, পৃঃ-৪]
যুগান্তর, দৈনিক সংবাদপত্রে,’হিন্দী কমিশন‘ নামে একটি সম্পাদকীয় লেখা হয় ৯ জুন, ১৯৫৫ তারিখে সেখানে বলা হয়েছে, ’... ভারতের প্রত্যেক
(৯)
রাজ্য হইতে এক একজন প্রতিনিধি লইবার নীতি যত দূর সম্ভব এ ক্ষেত্রে অনুসরণ করা হইয়াছে...
’... রাষ্ট্রপতি দ্বারা এই কমিশন ভারতীয় সংবিধানের কয়েক বৎসর পূর্বে রচিত নির্দেশ অনুসারে হইলেও, ইহা দ্বারা যে বর্তমান ভারত গভর্নমেন্টের হিন্দী প্রচারের এবং হিন্দীভাষাকে রাষ্ট্রভাষার পূর্ণ মর্যাদাদানের আগ্রহ প্রকাশ পাইতেছে সে সম্বন্ধে কোনও সন্দেহের অবকাশ নাই
’কেবল অ-হিন্দী ভাষাভাষীরাই যে হিন্দীকে একটি প্রথম শ্রেণীর ভাষার মর্যাদা দিবার কোন কারণ দেখিতে পান নাই তাহা নহে, কোন কোন নেতৃস্থানীয় হিন্দীভাষাভাষী ভদ্রলোকও হিন্দীর অপূর্ণতা উপলব্ধি করিয়া হিন্দী প্রচারে তাড়াতাড়ি করার বিরুদ্ধে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন অহিন্দী ভাষাভাষীদের মধ্যে শ্রীরাজা গোপালাচারীর নাম সর্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য রাজাজী গান্ধীজীর সহকর্মী এবং বরেণ্য কংগ্রেসনেতা তিনি অকারণে অথবা তুচ্ছ কারণে(যথা প্রাদেশিক পক্ষপাতিত্ব) হিন্দীর বিরোধিতা করিবেন, ইহা কেহ মনে করিতে পারেন না ... তিনি স্পষ্ট বলিয়াছেন যে, হিন্দীভাষা বাংলা, কিংবা তামিল এমনকি গুজরাটি ভাষা অপেক্ষাও যথেষ্ট অনুন্নত অথচ সেই ভাষাকে ভারতের মত একটি বিশাল ও বিখ্যাত রাষ্ট্রের সরকারীভাষা করিবার জন্য যেমন হিন্দী ভাষাভাষীদের তেমনি ভারত গভর্নমেন্টের ব্যস্ততার সীমা নাই‘
ভারতের একজন হিন্দিভাষী প্রধানমন্ত্রী একবার ১৫ আগস্ট সকালে লালকেল্লা থেকে (রেডিয়োতে) বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তিনি হঠাৎ আটকে গেলেন, ”ভারত কী“ বলবেন, নাকি ”ভারত কো“ বলবেন? হিন্দিতে তাৎক্ষণিকভাবে লিঙ্গ নির্ধারণ করা যে কত কঠিন তা দেখে অবাক হতে হল দ্বিতীয়বারে তিনি অবশ্য ”ভারত কো“ বলে দু‘বার উচ্চারণ করে বোধহয় পূর্ববর্তী ভুল শোধনের চেষ্টা করলেন এটি রেডিয়োতে নিজের কানে শোনা, তাই কোনও লিখিত তথ্য হাজির করা সম্ভব নয়
একজন হিন্দি শিক্ষককে প্রশ্ন করা হয়েছিল যে, হিন্দিতে লিঙ্গের ব্যাপার নিয়ে যে সমস্যা, অস্পষ্টতা তা কেমন করে এড়িয়ে একজন নবাগত হিন্দি শিখবেন? তিনি জবাবে বলেন, লিঙ্গ নিয়ে চিন্তা করবেন না, শিখে যান এরকম অস্পষ্ট উত্তর কোনও দিকনির্দেশ করে না
আমাদের আকাশে প্রায় শ‘দেড়েক আকাশী হিন্দি বিশ্ববিদ্যালয় চালু রয়েছে তারা সবেগে ভারতীয়দের হিন্দি শেখাচ্ছে, এবং সঙ্গে ’ভার্তীয় সংস্কৃতি‘ শেখাচ্ছে সাধারণ বিদ্যালয় ১১টা থেকে ৪টা অবধি খোলা, কিন্তু এ বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা(এবং অন্যান্য ভাষা) বিদ্যা লয় করার জন্য দিবারাত চব্বিশ ঘণ্টাই কোমর বাঁকিয়ে, বক্ষ দুলিয়ে খেটে যাচ্ছে এ বিদ্যা লয় নিকেতনে যেতে হয় না, বিদ্যা লয় নিকেতনই কানের কাছে, চোখের সামনে হাজির ছবি এবং উদারণ সহ সংস্কৃতির সংকীর্তন চলছে অহরহ সবাই শিখছে আপ্লুত হয়ে
(১০)
ছবি ছাড়া এফএমও কম যায় না, গানের একটা লাইন শুরু হলেই চারিদিকে তরুণ গায়কেরা (থুড়ি তরুণীরাও) দোহার হয়ে ধরতাই দেয় তখন কী আনন্দ! ঘুর্ণনরত কুমোরের চাকার মতো করে কোমরের নানা কসরতেও নিষেধ নেই এতে বেশ সুন্দর একটা ভার্তীয় সংকীর্তির পরিবেশ তৈরি হচ্ছে কী বিস্ময়, শাসনতলে ভারত জয়, আর বসনতলে বিশ্বজয়! কিন্তু তা করলেও কি শেষ রক্ষা হবে?
একটি বিষয়ে এখানে উল্লেখ করা দরকার ভারতে টিভি, সিনেমায় যে নারী অবমাননা ঘটছে, নারীর মান নিয়ত ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে, তার কি কোনও প্রতিকার হবে না? আমাদের রাষ্ট্রপতি একজন মাননীয়া নারী, শাসক প্রধান দলের শিরোভাগে আছেন একজন নারী, শাসক দলের প্রধান শরিক যাঁরা সেই দলের প্রধান একজন নারী, আমাদের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী একজন নারী, সংসদে নারীদের জন্য ৩০%শতাংশ সংরক্ষণ রাখার ব্যবস্থা হচ্ছে (লোকসভার বিরোধীনেতৃ একজন নারী-২০/১২/২০০৯) তবুও কেন এত নারীর অবমাননা দেশে? এর সুষ্ঠু এবং সঠিক প্রতিকার হোক
একটি বহুলপ্রচারিত ইরেজি কাগজের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায়(পৃষ্ঠা-১৮) গত ১৭ নভেম্বর-২০০৭ তারিখে প্রশান্ত্ অগ্রওয়াল লিখিত নিবন্ধ Myths About English পড়ে জানা গেল-- We have developed a common cultural currency
through television and Bollywood. বলিউডের অর্ধনগ্ন ধৈই নৃত্য তাঁর কাছে ব্যাভিচার মনে না হয়ে ”সংস্কৃতি“ বলে মনে হচ্ছে? সংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর কি ধারণা এটাই? তা ”মহাশয়-লেখকেরা“ যা বলবেন আমরা সাধারণ মানুষ কেমন করে তা না-মেনে চলতে পারি?
শ্রীঅগ্রওয়াল যদি মনে করে থাকেন যে ইংরেজি বাদ দিয়ে ভারতের ঐক্য বজায় থাকবে, তবে সে ঐক্য হবে নিশ্চয়ই হিন্দির পতাকাতলের ঐক্য
ইংরেজির ভাজার কড়াই থেকে তা হিন্দির জ্বলন্ত আগুনে ঝাঁপ দেওয়া ছাড়া আর কি? লোককে ইংরেজির দাস থেকে কি তিনি হিন্দির দাস হতে পরামর্শ দেন_ ’এটা অন্তত দিশি ভাষা‘, এরকম একটা দেশাত্মবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে?
হিন্দির ’Ambassador‘ বলা হত যে-ভাষাচার্যকে সেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মহাশয় হতাশ হয়ে বলেছিলেন I am seeing an incipient Hindi imperialism সে কথাটি কি নিবন্ধ লেখকের জানা আছে? কথাটা সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মুখ ফস্কে বলে ফেলেন নিএর সঙ্গে জুড়ে তিনি বলেছেন, ”...which will be all the more anti-national“ পৃঃ-৪, বইটির নাম হল, Letter from Sri B.G. Kher, Chairman, Official Language Commission, to the President of India, Forwarding the report of the Commission. রিপোর্টের তারিখ হল ৩১ জুলাই, ১৯৫৬
আর একজন হিন্দিপ্রেমী বাঙালি ভূদেব মুখোপাধ্যায় উদ্যোগ নিয়ে বিহারে হিন্দির প্রসার ঘটান এখন বিহারের ভাষা হিন্দি হলেও, হিন্দি কিন্তু বিহারের প্রধান ভাষা ছিল না সেখানে ছিল এবং আছে -- ভোজপুরী, মগহি(মগধী),
(১১)
মৈথিলী, বাংলা ইত্যাদি নানা ভাষার এক বর্ণময় সমাবেশ এখন অবশ্য বিহার থেকে বিভক্ত হয়ে ঝাড়খণ্ড আলাদা রাজ্য ঝাড়খণ্ডে পড়েছে বাংলাভাষীদের প্রধান অংশ সেখানে বাংলাভাষীরা নাকি জনসংখ্যার ৪২% শতাংশ, শোনা যায় বেশির ভাগ জেলা জুড়েই তাদের প্রাধান্য
ভারতের Official Language Commission(1956)-এ সদস্য হিসেবে ডঃ সুনীতি কুমার চ্যাটার্জি যে Note of Dissent দেন সেখানে বলা হয়েছে, I regret I cannot accept many of the Conclusions and Recommendations as presented in the Report (page-275).
সুনীতিকুমার, যিনি পরে ভারতের জাতীয়-অধ্যাপক হয়েছিলেন, বলেছেন, I honestly feel that I am seeing an incipient "Hindi Imperialism", which will be all the more anti-national as Hindi has not yet acquired any Pre-eminence over the other languages of India except its weight of numbers. The cultured intelligentsia in the Hindi States are of course generally free from it, and some of them have shown the greatest concern over it. But the half-educated and uneducated people are bound to have a different reaction, and it is the common men-- the masses -- was really count in a matter like this, where a universal attitude of understanding and tolerance is so very vital. The Hindi-speaking people, like all human beings, are not free from Linguism, and their expectations have been raised very high. This is also my conviction, after careful observation and thinking, that the relegation of English to a secondary place in our education and public life will ultimately not be for the good of the country. Hence, I beg to differ from the findings and recommendations of the commission's Report. (page-278-9).
সংবাদপত্রের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার আগে কংগ্রসের উদ্যোগে ১৯৩৭-এ তৎকালীন মাদ্রাজে হিন্দি চাপানো হয়েছিল, এবং তা নিয়ে সেখানে তুমুল বিক্ষোভ হয় ১৯৬৫-তে অগ্নিতে আত্মাহুতি দেওয়ার ঘটনাও ঘটে
(When the Congress ministry imposed Hindi in Madras presidency in 1937,
anti-Hindi protests rocked the region.
By the late 1930s, the ... anti-Hidi politics of Perier was demanding an independent Dravida Nadu; Dravidian roots and Tamil language were to be the defining features of the nation.
... He[Annadurai] received absolute loyalty from his followers; they were willing to die for him. Self-immolation was a form of protest during the anti-Hindi agitation in 1965. --The Times of India, August 15, 2007) সাক্ষ্য তো দেয় ঘটনা, স্তোকবাক্য তো কিছু সাক্ষ্য নয় তাই ১৯৪৭-এর পরে সারা ভারতেই যে ১৯৩৭ হতে যাচ্ছে না, তার নিশ্চয়তা কী? আর তাতে ১৯৩৭-এর মতোই যে বিক্ষোভও হবে, তাও তো একই রকম ভাবে অনুমিত! কিন্তু এটাও
(১২)
ঠিক যে, সর্বত্র তো কট্টর তামিল রাজ্যের মতো তামিলদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন হবে না, আর সেটাই তো হিন্দি প্রসারের ফাঁক! সবটাই তো আর তামিল রাজ্য নয়, ফলে বিরোধ বিক্ষোভ জমতে অনেক অনেক সময় লাগবে, ততোদিনে... ভোঁ কাট্টা
আকাশে আকাশে হিন্দি উচ্ছব চলেছে প্রতিরোধ কমে তো যাবেই, আদৌ প্রতিরোধ থাকবে কিনা বলা যায় না ফল? পাঁজিতে দেবীর শুভাগমনের ফল লেখা আছে-- শস্যশ্যামলা ধরণী আর, অন্যদের জন্য মড়ক, জীবিকার জন্য ফুটিফাটা ধূলিপূর্ণ ধরণী কারণ, ভাষা হল জীবন ও জীবিকা মূল হাতিয়ার
সংবাদপত্রের একটি রিপোর্ট বলছে, ”কেন্দ্রের সার্কুলারের সমালোচনা নিজস্ব প্রতিনিধি, নয়াদিল্লি -- সারা দেশের সমস্ত কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে সমাজবিদ্যা ও কলাবিদ্যার সমস্ত ক্লাশে একমাত্র হিন্দির মাধ্যমে শিক্ষাদানের যে সার্কুলার কেন্দ্রীয় সরকার জারি করেছেন, আজ রাজ্যসভা অধিবেশনের উল্লেখপর্বে সি পি আই(এম) সংসদ সদস্য দীপেন ঘোষ তার তীব্র সমালোচনা করেছেন তিনি বলেন, এই সার্কুলার কেন্দ্র ঘোষিত নয়া শিক্ষানীতিরও বিরোধিতা করছে এই সার্কুলার প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, সব ভাষাতেই শিক্ষার সমান সুযোগ রয়েছে এভাবে একটি ভাষাকে শিক্ষার মাধ্যম হিসাবে জোর করে চাপিয়ে দিলে তাতে বিচ্ছিন্নতাবাদই প্রশ্রয় পায়(গণশক্তি, ২৫নভেম্বর,১৯৮৬) সার্কুলারটি প্রত্যাহার করা হয়েছিল কিনা বলা নেই, সেসময়ে প্রত্যাহার যদি করা হয়েও থাকে, পরবর্তীকালে তার প্রয়োগ কি বন্ধ রয়েছে?
ইংরেজ আমলে যে ধাতু মুদ্রা চালু ছিল, তার ’এক আনা‘(বর্তমান মূল্য, ছয় পয়সার সমান) মুদ্রায়(১৯৩৯) লেখা ছিল ইংরেজি, হিন্দি, বাংলা, উর্দু, তামিল ভাষায় ১৯৪৫-এর মুদ্রায়ও ঠিক তেমনি ছিল, ১৯৪৬-এর মুদ্রায়ও ঠিক তা-ই ছিল অর্থাৎ মোট পাঁচটি ভাষায় লেখা ছিল ১৯৪২-এর ’দুই পয়সা‘-তেও ঠিক তা-ই ছিল কোনও কোনও মুদ্রায় একটু ভিন্নতাও ছিল ১৯৪৭-এর একটি মুদ্রায় বাংলা এবং তামিল বাদ গেছে এরকম ভিন্নতা ১৯৪৫-এর একটি মুদ্রায়ও ছিল সব সময়ে যে সবকটি ভাষায় লেখা হত তা নয়, শাসকদের মর্জি মত তা কমত বাড়ত ১৯১৯-২০ এর তামা আর নিকেল মিশিয়ে দিয়ে তৈরি ’আট আনায়‘ (বর্তমান মূল্য ৫০ পয়সা) ছিল নাগপুরি, পারসি, বাংলা এবং তামিল ভাষায় ১৯১১-১৯২২ এর রুপোর একটাকায় যেমন ছিল পারসি ভাষা মনে রাখতে হবে যে, ভারতের রাজধানী ততোদিনে কোলকাতা থেকে দিল্লি নিয়ে যাওয়া হয়েছে(১২ ডিসেম্বর, ১৯১১) কিন্তু এখন তো টাকায় ইংরেজি এবং হিন্দি ভিন্ন কিছু নেই বিশ্বভারতের শাসন কাজের ভাষা ইংরেজি হওয়া সত্ত্বেও, ভারতের যে প্রধান ভাষাগুলিকে ইংরেজ প্রাধান্য দিত, তা এ আমলে কেন বাতিল করা হল? টাকায় কেন ভারতীয় আত্মসংস্কৃতির প্রতিভূ বিশ্বমানব রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখা যায় না? যদিও বিশ্বজাতিসংঘের শিক্ষা বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক শাখা ইউনেস্কো(UNESCO)
(১৩)
রবীন্দ্রনাথের ১৫০তম জয়ন্তী বিশ্বজুড়ে পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে”রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ দুনিয়া জুড়ে পালন করবে ইউনোস্কো“ সংবাদ শিরোনাম, আজকাল, ৭/১০/২০০৯, বুধবার, পৃঃ-২ এছাড়া, আনন্দবাজার পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম--”রবীন্দ্রনাথের ১৫০ বছরের জন্মদিন বিশ্ব জুড়ে পালন করবে ইউনেস্কো“ (৭/১০/২০০৯,পৃঃ-৭) দুটি সংবাদই রবীন্দ্রনাথের ছবি সহ প্রচারিত হয়েছে
মনে হচ্ছে সুনীতিকুমারের কথা তথা, the relegation[অবনমন ঘটানো] of English to a secondary place in our education কথাটির প্রতি গুরুত্ব দিয়ে এতদিনে শিক্ষায় কেন্দ্রীয়ভাবে সারা ভারতে ইংরেজিকে গুরুত্ব দেবার চেষ্টা হচ্ছে কিন্তু দুর্মুখেরা বলছে, বাঘ যেমন তার শিকারের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে একটু পিছিয়ে এসে ঘাপটি মেরে বসে, তার পরে সর্বশক্তি নিয়ে শিকারের ঘাড়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, ইংরেজির প্রতি এতকাল পরে এই সোহাগ দেখানো হল সেই ঝাঁপিয়ে পড়ার পূর্ব মুহূর্ত বলা হয়েছে, Devanagari is the script of the Sanskrit language.(page-220). কিন্তু ভাষাবিদেরা বলছেন যে তথাকথিত ’দেবনাগরি‘ নামক লিপিটি সংস্কৃতের লিপি নয়কোনও ভাষার লিপি হল-- সেই ভাষাটি যে লিপিতে লেখা
হয় সেটি ভারতের নানা স্থানে সংস্কৃত লেখা হয় সেই-সেই অঞ্চলের লিপিতে বেণীমাধব শীল সম্পাদিত ’কাশীদাসী মহাভারত‘ গ্রন্থের ভূমিকায় (২৫বৈশাখ, ১৩৯৪) বলা হয়েছে-- ”প্রাচীন মহাভারতের পুঁথি মোট আট প্রকারের লিপিতে পাওয়া গিয়াছে--(১)কাশ্মীরাঞ্চলে শারদা-অক্ষর (২)মধ্য ও উত্তর ভারতে নাগরী অক্ষর(৩)মিথিলা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে মৈথিল অক্ষর (৪) পূর্বভারতে বাঙলা অক্ষর(৫)নেপালাঞ্চলে নেপালী অক্ষর(৬)দাক্ষিণাত্যে তামিল অক্ষর(৭)তেলেগু অক্ষর এবং (৮)মালয়ালম্ অক্ষর“ এই তথ্য থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, কোথাও কিন্তু ”দেবনাগরি“ নামক কাল্পনিক হরফে প্রাচীন মহাভারত লেখা হয়নি, এবং বোঝা যাচ্ছে এই ক‘টিই ছিল প্রধান অঞ্চল যদি আরও প্রাচীন দিনের দিকে তাকাই দেখা যাবে, সংস্কৃত লেখা হয়েছে ব্রাহ্মী লিপিতে আর এই ব্রাহ্মী লিপিই হল ভারতে(আজ অবধি পঠিত) প্রাচীনতম লিপি তাই, যদি কোনও লিপিকে ’সংস্কৃতের লিপি‘ একান্ত বলতেই হয় তবে তা হওয়া উচিত ব্রাহ্মী লিপি বেদ এক কালে লিখিত ছিল না, মুখে মুখে চলত, তাই তার নামই ছিল শ্রুতি, পরে তা লিখিত হয়
ভারতের স্বাধীনতার পরে ভারতের শাসনের কাজে কোন্ ভাষা চলবে তা নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে যে ’ভাষা কমিশন‘ তৈরি হয় তার চেয়ারম্যান শ্রী বি.জি. খের নিজে কি ভাষাবিদ ছিলেন? ভাষাকমিশনের রিপোর্টের যাঁরা বিরোধিতা করেছেন, সেই দুজনের একজন ভাষাপণ্ডিত বলে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত তিনি ডঃ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং অন্যজন ডঃ সুব্বারায়ণ (Member, Rajya Sabha, Madras -- Madras)
(১৪)
বলা হয়েছে, Dr. Subbarayan observes "I fear that in the entire Report there is very little evidence of understanding, imagination and sympathy for the non-Hindi speaking people of India."(Ref. paragraph 3).
শ্রী বি.জি. খের বলেছেন, "I submit this is grossly unjust to all the other
members... There are Several other grossly unfair aspirations in these two dissenting Notes" (p-4).
অতীব দক্ষ লোককেই ভাষাকমিশনের চেয়ারম্যান করা হয়েছিল কারণ
১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ভাষাকমিশনের চেয়ারম্যান হবার ঠিক আগে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের
১৫ আগস্ট শ্রী বি.জি. খের(বাল গঙ্গাধর খের) ভারতের রাষ্ট্রীয় অতি উচ্চ খেতাব পদ্মবিভূষণ লাভ করে ছিলেন সেবারই প্রথম দেশে রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদান শুরু হয় এবং শ্রীখের উচ্চ খেতাব পান আর তিনি ভাষাকমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োজিত হন এর এক বছরের মধ্যে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে এর আগে শ্রীখের(২৪.৮.১৮৮৮-০৮.০৩.১৯৫৭) ...was Chief Minister of Bombay (in 1937) and again in 1946. তা ছাড়া, he was Indian high Commissioner in U.K.(London) and returned to India early 1954.[The Pageant of life (Life of
B.G.Kher) ed. by - S.B.Kher & G.K.Rao]. শ্রীখেরের জন্ম মহারাষ্ট্রে(বম্বে) তিনি অনেক ভাষায় সুদক্ষ ছিলেন মারাঠি, ইংরেজি, কানাড়া ছাড়া তিনি গুজরাটি ও হিন্দিও খুব ভালো জানতেন
"9. So far as Sri Maganbhai Deshai's long note of Explanation is concerned, it is only a re-statement of points which already find full
expression in the Report at appropriate places. The only important specific points of disagreement that I can see in his Note are the following:-
(1) The constitution should be amended so as to cast a definite duty on the State Govts. to instruct compulsory instruction in Hindi.
(2) He disagrees with the view in the main Report relating to compelling Hindi students to learn a non-Hindi Indian languages." p-7.
শ্রীমগনভাই দেশাই যে মূল বিষয়টিকে অত্যন্ত কঠোরভাবে উপস্থাপন করেছেন, পার্থক্য এইখানে যে, চেয়ারম্যান শ্রীখের সেই একই বিষয়কেই একটু ঘুরিয়ে নাক দেখিয়েছেন, নয় কি?
যাঁরা বিরোধী নোট দিয়েছেন, সেই ডঃ এস.কে. চ্যাটার্জি এবং ডঃ সুব্বারাও যে 'two classes of citizens' in India এবং 'Hindi-Imperialism', বলে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন সে আশংকা সত্য প্রমাণের আর কতটা বাকি?
শ্রীখের উল্লেখ করেছেন বিরোধী রিপোর্টের কিছু অংশ, ” "Hindi was selected out of the 14 main languages of the country as enumerated in the Eighth Schedule of / to that constitution, by the Constituent Assembly of India and not by a parliament consisting of properly / directly elected
(১৫)
representatives of the people."*(Italics mine)“ p-8.
এটা সত্য কিনা তা কর্তাব্যক্তিরা বলতে পারবেন
শোনা যায়, স্বাধীন ভারতের Constituent Assembly যখন ভারতের সরকারি কাজের ভাষা কী হবে তা স্থির করতে ভোট নেয় তখন সেখানে তো মাত্র এক ভোটে হিন্দির জয় হয়! বহুক্ষণ পরে আবার ভোট নিলে হিন্দির বিরুদ্ধে এক ভোট কমে যায়৻ এত বড় সিদ্ধান্তটা, বলা চলে ভারতের সংবিধান সভার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা মাত্রই একভোটে স্থির হল? হতে পারল? এই ভাষার প্রশ্নেই Constituent Assembly-তে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়েছে বলে সংবিধান সভার সভাপতি শ্রী বি.আর. আম্বেদকর জানিয়েছেন যা কিনা আবার "not by a parliament consisting of properly / directly elected representatives of the people." কথাটির দিকে সুধীজনের মনোযোগ আকৃষ্ট হোক
P. Kodanda Rao তাঁর লেখা Language issue in the Indian Constituent Assembly1946-1950 বইখানিতে বলেছেন, Dr. B. R. Ambedkar, who as
chairman of the Drafting Committee of the Constitution, said in December 1955: "It may now not be a breech of a secret if I revealed to the public what happened in the Congress party meeting when the draft Constitution of India was being considered on the issue of adopting Hindi as the national language. There was no Article which proved more controversial than
Article 116 which deals with this question. No articles produced more opposition, no article more heat. After prolonged discussion when the question was put, the vote was 78 against 78. The tie could not be resolved. After a long time when the question was put to the Party meeting, the result was 77 against, 78 for, one vote. As chairman of the Draft Constitution, I had naturally entry to the Congress Party enclosure."
"Mr. Frank Anthony said: As a member of the Steering Committee-- I was a member of the Congress party -- I was invited to its deliberations. The decision to make Hindi even as an official language just scraped through by one vote. ...with much richer and much older languages than Hindi, languages like Tamil and Bengali, we will never be able to have a national language." (p-4).
"... The language issue was raised first on December 10, 1946, and settled on September 17, 1949! "(p-6). অর্থাৎ প্রায় তিন বছরকিন্তু ভাষা নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে ভারত স্বাধীন হবার আগে থেকেইতা কেবল সংবিধান রচনার সময়েই প্রয়োজনীয় বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়নি ভারতের শিক্ষা,
(১৬)
আর্থিক সুব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা, বাসস্থান ইত্যাদি নিয়েও কি স্বাধীনতার আগে থেকে এত ভাবনার তোলপাড় শুরু হয়েছিল?নাকি তা কেবলই ভাষা নিয়ে?ভাষা হল জীবন ও জীবিকার মূল হাতিয়ার, সেজন্যই কি সেই হাতিয়ারকে এককভাবে কব়্জা করার জন্য এই অস্বাভাবিক তোলপাড়?প্রশ্ন স্বাধীনতার লড়াইয়ে এই
তোলপাড়-করিয়েরা কতটা ছিলেন?নাকি কেবলই নেপোয় মারে দই৻ভারতের শিক্ষা, আর্থিক সুব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, চিকিৎসা,বাসস্থান ইত্যাদি নিয়ে তাঁদের নেই
কোনও ভাবনাই, কেবলই তা ভাষা দখল করা চাই?
কোন এক সদস্য সংবিধানের Draft Postpone করে রাখতে চেয়েছিলেন
নতুন নির্বাচন না হওয়া অবধি "But some other members were determined to settle the issue in the Constituent Assembly and made part of the Constitution, as the protagonists of Hindi were more confident of victory in the current Constituent Assembly than in the future Parliament. Some of them even feared that they would lose in the election to Parliament if they did not secure Hindi in the Constitution while some non-Hindi members feared that, if Hindi found a place in the Constitution, they would lose in the election to Parliament." (p-8) স্বাধীন ভারতে শাসনের ’সরকারি ভাষা‘ কী হবে, সেটা জীবনমরণের প্রশ্ন যে ছিল, তা এতে স্পষ্ট বোঝা যায়
আশ্চর্য এই যে, একদল জীবিকা দখল করতে চাইছেন, আর অন্য দল তা রুখতে চাইছেন, প্রতি আক্রমণ বা দখল নয়, কেবলই আত্মরক্ষা এই যদি হয় অবস্থা তবে এটা খুব পরিষ্কার যে, ভাষা নিয়ে বাকি ভারত, তথা সিংহভাগ মানুষের কথাই ভাবা হয়নি কোনও রকমে কাজটা হাসিল করায় সকল তৎপরতা প্রকাশ পেয়েছে এটা কি ভারতের কোনও শুভ ফলদায়ী ব্যবস্থা হয়েছে, তা নতুন করে ভাবার দরকার
এই বইয়ের পৃঃ-১৪ তে বলা হয়েছে, "The Ayyangar Formula, with the Munshi amendments, was approved without a vote late in the evening of September 15, 1949. But Moulana Hazarat Mohani's adverse vote was not recorded on the ground that there was provision for it in the Rules of Procedure of the Assembly!" ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না, বিরূপ ভোট(adverse
vote) বলে তা গ্রাহ্য করা হবে না? তা হলে কি স্বপক্ষে ভোট হলে তা গ্রাহ্য করা হত? এমনি করেই কি সংবিধান সভায় দখলদারির চোরা স্রোত বয়ে চলেছিল?
এই বইয়ের পৃঃ-৫৩ তে বলা হয়েছে, "Mr. Jaipal Singh of Bihar said that English took one-tenth of the time taken by Hindi to print the same number of pages and Hindi would slow down Commercial business." সবার পক্ষে সমান দূরত্বের ভাষা, তথা নিরপেক্ষ ভাষা ইংরেজি একমাত্র না হওয়ায়,
সর্বত্র কাজকর্মের গতি শ্লথ হয়ে গেছে Mr. Jaipal Singh-এর কথা কিন্তু
(১৭)
সত্যিই ফলেছে, বিশেষ করে ইংরেজি হিন্দি দুটো ভাষায় লিখতে গিয়ে
শ্রীখের উল্লেখ করেছেন বিরোধী রিপোর্টের কিছু অংশ, যেখানে বলা হয়েছে, ” "It (that is the Report) is also seeking to place as some thing
conclusive before the non-Hindi peoples of India that it will be both an act
of patriotic duty and an urgent and necessary reform to replace English by
Hindi as quickly as possible, and to take in Hindi to saturation in their judicial and administrative bases / spheres, in their educational set up, and
consequently even in their most intimate being," * in every aspect of their
life(Italics mine).“ (p-8) .
"(ii) Dr. Chatterji has argued in 'c'(xii) of his Note against the injustice of Hindi being made the sole language for all-India civil and other Service examinations and how non-Hindi speakers will have to study through Hindi and answer questions in Hindi as consequence thereafter. No such view is advocated in the Report in which it is specifically recommended that other regional languages would also be eligible as linguistic media for these examinations." (p-8) .
দৈনিক সংবাদপত্র আনন্দবাজার পত্রিকায় ৯ জুন ২০০৯ একটি চিঠি দেখেছিলাম, সেটি এরকম--
ইংরেজিই একমাত্র ভাষা হোক
’উচ্চশিক্ষার ভাষা‘(সম্পাদকীয় ১২-৫) সর্বাংশে সমর্থন করি ইংরেজিই উচ্চ শিক্ষার ভাষা হওয়া উচিত কিন্তু সর্বভারতীয় নেট পরীক্ষায় ইংরেজি একমাত্র ভাষা নয় বিকল্প ভাষা রাখা হয়েছে হিন্দি এটা কি ঠিক? হিন্দিভাষী
পরীক্ষার্থীরা মাতৃভাষায় প্রশ্ন পাচ্ছে, মাতৃভাষায় উত্তর লেখার সুযোগ পাচ্ছে আমাদের ক্ষেত্রে ইংরেজিই আবশ্যিক হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের আবেদন, নেট পরীক্ষার একটিই ভাষা হোক, এবং তা হোক ইংরেজি হিন্দি এখনও মোটেই
সর্বভারতীয় ভাষা হয়ে ওঠেনি ইংরেজির বিকল্প হিন্দি হতে পারে না ইউ জি সি অবিলম্বে ব্যবস্থা করুক
বলবর্ধন বল বোলপুর, বীরভূম
ভারতবাসী যে ক্রমে উত্যক্ত ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছেন, তার নানা প্রমাণ প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে যেমন একটি চিঠি থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা যাক-- ’বাংলা উপেক্ষিত‘ শিরোনামে লেখা চিঠিতে প্রবোধচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন, ”রেলে কর্মচারী নিয়োগের যে পরীক্ষা গ্রহণ করা হয় তাতে আঞ্চলিক ভাষাকে মর্যাদা না দিয়ে শুধুমাত্র ইংরেজি ও হিন্দি ভাষাতে প্রশ্নপত্র তৈরি করা হয় হিন্দিতেও প্রশ্নপত্রের উত্তর দেবার সুবিধা আছে ফলে স্বাভাবিক ভাবেই হিন্দিভাষী অঞ্চলের প্রার্থীরা বাড়তি সুবিধা পাচ্ছেন“ (আজকাল, ১২অক্টোবর, ২০০৯, পৃঃ-৪) এটা কি কেবল একটি অঞ্চলের মানুষের ক্ষোভ? এই ক্ষোভ সারা ভারত
(১৮)
জুড়ে মানুষকে কুরে কুরে খাচ্ছে, কারণ এ যে সরাসরি জীবিকার প্রশ্ন একদল নিজের ভাষায় পরীক্ষা দিয়ে একপেশে সুযোগ নিয়ে জীবিকায় প্রতিষ্ঠিত হবে, আর অন্যরা নিজের হাত কামড়াবে আর বসে বসে দেখবে এসব কতদিন চলতে পারে? ভুল এবং অত্যন্ত একপেশে অদূরদর্শী নীতির ফলে বারুদ জমছে এসব
কি সংশোধন করা হবে, নাকি বিস্ফোরণের জন্য অপেক্ষা করা হবে? বিস্ফোরণ কিন্তু হবেই, সেটা স্বীকার না করলেও, দেখে মনে হচ্ছে পরিণতির দিকে ঘটনা এগোচ্ছে বৃষ্টির ফোঁটা-- এক ফোঁটা, দু-ফোঁটা গায়ে লাগে না, আবার সেই বৃষ্টির ফোঁটায় কিন্তু দেশ ভেসে যায়, বাঁধ ভেঙে প্রলয় কাণ্ড ঘটে
ইংরেজি এখন অবধি(আংশিক হলেও) আমাদের জীবিকা দিচ্ছে, হিন্দি এখন আমাদের কী দিচ্ছে? ভবিষ্যতে কী দেবে? হতাশ কেউ যদি এই প্রশ্ন দুটির উত্তর যথাক্রমে মনে করে, বঞ্চনা, এবং দাসত্ব, তবে সেটা হবে দেশের গণতন্ত্রের পক্ষে অশুভ তাই দেশনেতাদের ভাববার সময় হয়ছে, কী ভাবে মানুষের হতাশা দূর করা যায় নয়তো সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের শাসন আর স্বাধীনোত্তর দেশীয় শাসনে আর ভেদ কী রইল? তা কি হয়ে উঠবে কেবলই ’সাদা‘ আর ’কালো‘র রঙের ভেদ মাত্র, শোষণের কোনও ভেদ থাকবে না? আমরা তো দেশটাকে সুষ্ঠু ও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চাই, ভাঙতে তো চাই না তাই মানুষের মনে কেন ক্ষোভ তা খুঁজে দেখে তার সঠিক প্রতিকার করতে হবে কথায় বলে, শাসক পালটালেই, শোষণ পালটায় না-- আমরা কি সেই দুর্যোগে পড়ে যাব? স্বাধীনতা সংগ্রামের ফল তো এমন হতে পারে না কোথাও একটা ভুল থেকে যাচ্ছে
স্বাধীনতার মূল্য যে কী, তা ভারতবাসী বোধহয় বুঝতে শুরু করেছে এখন ২০০৯ খ্রিস্টাব্দ, ভাষা কমিশনের রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ১৯৫৬-তে, অর্থাৎ ৫৩ বছর আগে অর্ধ শতকেরও আগে কিছু বুঝতে পারা যে বিদ্বজ্জনদের নির্বুদ্ধিতার চিহ্ন তেমন কোনও প্রবাদের কথা জানা নেই
হিন্দিকে সর্বভারতীয় ভাষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বহু আগেই ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে, বা তারও আগে, কিন্তু তা এখনও তেমন হয়ে উঠতে পারেনি ১৮৯৪
সালে প্রতিষ্ঠিত ’নাগরী প্রচারিণী সভা‘ নিয়ে লিখতে গিয়ে রেভারেন্ড এডউইন গ্রিভস লিখেছেন, ’এই সভার উদ্দেশ্য সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে হিন্দিকে প্রচার করে বহুভাষার এই ভারতে হিন্দিকে একটি মূল যোগাযোগের ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা দেওয়া সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে যদি যোগাযোগের ভাষা হয়ে উঠতে পারে তবে তার চেয়ে ভালো কথা কী হতে পারে ভারতবাসী হিসেবে প্রতিটি ভারতবাসীর একটি মূল ভাষা থাকলে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ভারতের পরিচয় সম্পূর্ণ এক অন্য মাত্রা পাবে একটি ভাষা একটি জাতিকে বেঁধে রাখতে পারে
’একই সঙ্গে গ্রিভস লিখেছেন ভবিষ্যতে ভারতে সর্বসাধারণের যোগাযোগের ভাষা হবে ইংরেজি, রাজধানী কলকাতাতে যেভাবে এই ভাষার প্রসার এবং শিক্ষা
(১৯)
বৃদ্ধি পেয়েছে তা আশ্চর্যজনক‘ (দৈনিক স্টেটসম্যান, ১৬ অক্টোবর, ২০০৭ দ্য স্টেটসম্যান, শতবর্ষ আগে, ১৬ অক্টোবর, ১৯০৭)
একটা খুবই লক্ষ করার মতো কথা হল, "It is difficult to foresee how fast non-Hindi speaking people can take to Hindi so as to possess equal competitive ability." (p-276) বইপড়ে-শেখা ভাষা নিয়ে, একজন মাতৃভাষীর সাথে কখনও প্রতিযোগিতায় এঁটে ওঠা যায় না, মাতৃভাষীকেই যদি একজন বিভাষী পরীক্ষার প্রতিযোগিতায় হারিয়ে দেয়, তবে সেটা কী করে সেই স্বভাষীর মাতৃভাষা হল? লক্ষে একজন হয়তো মিলতে পারে, তবে সেটা তো সাধারণ উদাহরণ হতে পারে না আর জীবিকা লুঠের এটাই আসল চাবিকাঠিএই তো শিখে গেছ প্রায়, চেষ্টা করো, চেষ্টা করো, হবে চোখের সামনে মুলো ঝুলিয়ে রেখে মিছরি মাখানো মধুর প্রতারণা কেন যে হিন্দি-হিন্দি করে এত হেদিয়ে মরা তার গোড়ায় যে গভীর জল!
একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কথা জানা গেল, এই বইয়েরই ২০৭ পৃষ্ঠা থেকে,
2. We will first consider the question of propagation of the Union language, Hindi, amongst the non-Hindi-speaking peoples of the country. It is obvious that the provisions of the official language of the Union require, for their
satisfactory implementation in what we have called 'the private sector of national life' a great deal of propagation of knowledge of the Hindi language
amongst the non-Hindi-speaking populations, if there is to be an adequate underpinning[জোরালো করা] of the national language policy. Whereas the
constitution provides for change-over of the medium of the general business of the Union to Hindi by 1965, we would continue to have in our midst for a long time the adult population of the country, which has not had the benefit of a modicum[যৎকিঞ্চিৎ] of instruction in Hindi language, which, we have
advocated, should be imparted compulsorily at the secondary stages in the educational system of the country before completion of the compulsory age-limit of 14 years. Schemes for propagation of Hindi amongst the non-school-going population, therefore, are a matter of great importance for the satisfactory implementation of the language provisions of the constitution. (পৃঃ২০৭), এছাড়া, ৪৭৪ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে, It shall be the duty of the Union to promote the spread of the Hindi language. এই কারণেই কি অশিক্ষিত এবং অল্প-শিক্ষিত জনবৃত্তের জন্য ফুসলানো হিন্দি সিনেমা, সিরিয়াল, সংগীত, এফএম বাতচিৎ সরকারি পৃষ্ঠপোষণ পাচ্ছে? Catch them young? বাংলার সঙ্গে হিন্দি ইংরেজি মিশিয়ে জব্বর খিচুড়ি বানিয়ে বাংলার মতো শ্রেষ্ঠ ভাষাকে দুর্গন্ধ করার ধৃষ্টতা কি এ-ইচ্ছা সঞ্জাত? যারা এটা করছে তাদের সেটা চাকুরি, যারা পর্দার আড়ালে থেকে কলকাঠি নাড়ছে তাদের কী হবে? সমাজ কি তাদের
(২০)
মানবে? নয়তো, যে চলচ্চিত্র একমাত্র বিবাহিতদের দেখার জন্য অনুমোদন পেতে পারে, তেমন জিনিসও কেমন করে শিশু, কিশোর-কিশোরী সবার জন্যই উন্মুক্ত? বিষ বৃক্ষ রোপণ করার কুফল যে কী ভয়াবহ, তা ক্রমে টের পাওয়া যাচ্ছে সমাজের প্রতিটি স্তরে, প্রতিটি পর্যায়েলুম্পেন বানাতে চাইলে কী করে মহর্ষি হবে! এ অনৈতিকতা দেশকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, তা দেশ নেতারা ভেবে দেখেছেন কি? তাঁরা দেশের মানুষকে ভালো রাখলে তবেই তো মানুষ ভালো থাকবে, সুখে থাকবে, আনন্দে থাকবে নৈতিক থাকবে
সম্প্রতি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রীর অভিপ্রায় অনুসারে স্কুল স্তরে সারা ভারতে একটিই বোর্ড হলে, তার ভাষা-মাধ্যম কি হবে? এছাড়া, মাধ্যমিক অবধি কোনও পরীক্ষা দিতে হবে না, প্রথম পরীক্ষা নেওয়া হবে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে এর সরলার্থ হল, হিন্দি শিখে অহিন্দিভাষীরা সুবিধা করতে পারবে না ফলে প্রতিযোগিতায় সবার নীচে থাকবে, আর উচ্চমাধ্যমিক অবধি অবাধে গিয়ে প্রথম পরীক্ষায় যে লাড্ডু পাবে, তা কি বলার অপেক্ষা রাখে? এদের বেশিরভাগই এর পরের স্তরে, তথা স্নাতক পর্যায়ে পৌঁছাতে পারবেনা যারা শেষ অবধি পৌঁছাতে পারবে তেমন
অ-হিন্দিভাষীরা উচ্চবিত্ত, তারা শাসককূলের পোষিত হিন্দিভক্তদের সন্তান!
উপরে উল্লেখ করা শ্রীঅগ্রওয়াল তাঁর তালিকায় তামিল, তেলুগু, মারাঠি, গুজরাটি ইত্যাদি ভারতীয় ভাষাগুলির নাম উল্লেখ করতে গিয়ে বাংলা ভাষার নামটি ভুলে গেলেন কেন? ভারতের দ্বিতীয় জনগরিষ্ঠ এবং একমাত্র নোবেলপুরস্কার প্রাপ্ত ভাষা বাংলা, রবীন্দ্রনাথের ভাষা বাংলা, জাতীয় সংগীতের ভাষা বাংলা কি-- ’ইত্যাদি‘র তালিকায় স্থান পাবার মতো নয়? ইংরেজি আমাদের সংঘবদ্ধ করে, কথাটি তাঁর তেমন পছন্দ নয়, তাই ভারতীয় ভাষাগুলির মানুষেরা নিজেদের ভাষায় নিজেদের প্রকাশ করবে এমনই তাঁর পরামর্শ পরামর্শটি সাধু, কিন্তু তাহলে অন্য রাজ্যের মানুষের সাথে কথা বলতে হলে আমাদের কতগুলি ভাষা শিখতে হবে? সেটার কথা কি তাঁর মনে পড়েনি? ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চলাকালীন দেশের মানুষের মধ্যে কোন্ ভাষা যোগাযোগের ভাষা ছিল? অবশ্যই তা ইংরেজি ’বিদেশি‘ ’অত্যাচারী‘ ’সাম্রাজ্যবাদীর‘ ভাষা তারা বর্জন করেননি কারণ পরস্পর ভাব বিনিময়ের এ ছাড়া আর কোনও সহজ পথ ছিল না(এখনও নেই) পরাধীন ভারতেও তাঁদের এতে দেশাত্মবোধে, দেশপ্রেমে কোনও ব্যাঘাত ঘটেনি আজকে কেন ব্যাঘাত ঘটছে? সারা দেশের মানুষের মধ্যে তা হলে সাধারণ যোগাযোগের ভাষা কী হবে? সেটা নিশ্চয়ই হবে হিন্দি? নিবন্ধ লেখকের কি তেমনই গোপন বাসনা? নয়তো কেমন করে তিনি বলিউড এবং টিভির ’সংস্কৃতিকে‘ যৌথ সংস্কৃতি বলে সগর্ব উল্লেখ করেন?
সারা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে বহু দেশ বা রাজ্য ছিল, সেসব অংশকে দখলদার ইংরেজ নিজেদের স্বার্থেই দখল করে একত্র করেছিল, সম্পত্তি বাড়িয়ে
(২১)
ছিল আর তার সাধারণ যোগাযোগের ভাষা করেছিল-- স্বাভাবিক ভাবেই তাদের নিজেদের স্বার্থে নিজভাষা ইংরেজিকে নয়তো তারা দেশের নানা অংশে কাজই করতে পারবে না যে এ উপমহাদেশের এক-একটা ’দেশ‘ দখল করার সময়ে সে দেশের ভাষা শিখবে আগে? কিংবা সব ভাষা শিখে তারপরে তারা পুরো দেশ দখল করবে? ইংরেজদের সে দায় ছিল না(ক্ষুব্ধ কেউ হয়তো ভাববেন একালে ’হিন্দিওয়ালাদেরও‘ সে দায় নেই!) তাই অনায়াসে বলা যায় এত বিশাল ভারত গঠিত ও সংঘবদ্ধ হয়েছে, তথা দেশমাল্য গাঁথা হয়েছে ইংরেজির সুতো দিয়ে ভারতীয়রাও সেকারণেই অন্য অংশের মানুষের সঙ্গে তাই (দেশ শাসনের ভাষা) ইংরেজিতেই কথা বলত এই সকল-অঞ্চল আজ একীভূত হয়ে এক ভারত বটে, কিন্তু সেগুলি প্রকৃতপক্ষে ছিল তো প্রত্যেকটি প্রত্যেকের কাছে ”বিদেশ“ সেই ”বিদেশ“গুলি আজ একীভূত ভাবে আমরা যে পাচ্ছি তা সেই ইংরেজদের কারণে, ইংরেজির কারণে তারা অন্যায় অত্যাচার করে দেশ দখল করেছিল, সম্পত্তি বাড়িয়ে ছিল, কিন্তু তাতে দেশটাও তো একীভূত হয়েছিল, তাই আজ এই মহাভারত সেই মহাভারতকে আমরা কি আমাদের অযোগ্যতা, নিতান্ত অবিমৃশ্যকারিতায় আবার সেই টুকরো টুকরো ”বিদেশ“ করে ফেলব? আমাদের অযোগ্যতার কারণেই কি ইংরেজদের আগে আমরা পরস্পর ”বিদেশি“ ছিলাম? আমাদের এ অযোগ্যতা, এ দুর্মতি-- ইতিহাস কি ক্ষমা করবে? সবার সমান এবং অবাধ সুযোগ না থাকলে মানুষ পরস্পর সমব্যথী, সহযোগী হবে কেমন করে?
একদল রুপোর চামচে খাবে আর বাকিরা দূর-দূর করা ’মাছি খেদানো‘ পাবে, এটা কি চলে, চলতে পারে? গণতন্ত্রে তো নয়ই, কোনও তন্ত্রেই এটা চলে না নিজেদের কি আমরা নিতান্ত অযোগ্য প্রমাণ করার সাধনায় নেমেছি? ছিঃ! ভারত এক বিশাল শক্তিপুঞ্জ, তাকে নির্বুদ্ধিতায় কিংবা স্বার্থবুদ্ধিচিন্তায় ভেঙে ফললে তা কেবল বিন্দু-আলোক হয়েই থাকবে, শক্তি হবে না
এসব কোনও রাগ অভিমানের কথা নয়, এটাই বাস্তব সত্য যে, বিদেশি ভাষা ইংরেজিকে সুবিধা মত একবার বলা হয় ’বিদেশি সাম্রাজ্যবাদীর‘ ভাষা,
আবার অন্য সুবিধা আদায় করার জন্য সেই ইংরেজিরই আশ্রয় নিতে বাধা নেই? একটি ইংরেজি কাগজে সংবাদ দেখেছি যে, ২০০৭ থেকে উত্তর ও মধ্য ভারতে তথা সমগ্র হিন্দি বলয়ে প্রাথমিক স্তর থেকে ইংরেজি শেখা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে (With the start of the new academic year in July, almost all government schools in the Hindi heartland will introduce English in the school curriculum of their primary sections... the importance of teaching English has been recognized in the Hindi belt ... What has clinched the case for compulsory English in schools, ... is a bread-and-butter problem. --English in the Hindi belt- Ravi Vyas, The Telegraph, 20 July,2007, p-15) এর মানেটা কি এই দাঁড়ায় না যে, ”আমরা“ ইংরেজির দাস হয়ে ’গাছেরও খাবো,
(২২)
তলারও খাবো‘, আর তোমরা আপামর ভারতবাসী আমাদের(হিন্দির) দাস হয়ে থাকো?
কোলকাতা বইমেলায় এক সভায় একজন প্রাজ্ঞ হিন্দিভাষী কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, মানুষ হিন্দির এই মাথায় চাপা নিয়ে কথা বলতে কেন ভয় পায়?
পায়, তার কারণ তো, চাপাবার মধ্যেই নিহিত
হিন্দির পক্ষে, বা বিপক্ষে যা-ই বলা হোক, যত পাহাড়প্রমাণ তথ্যাদি জড় করে প্রমাণ উপস্থিত করা হোক-- সেসবে বৃথাই শ্রম ব্যয় হবে হিন্দি আছে, থাকবে, চলবে, তাই হে নরপুঙ্গব বাক্যব্যয়ে বৃথা শ্রমশ্রান্ত হয়ো না বরং শত শত চ্যানেল চালু আছে, সেখানে নিতিদিন শিক্ষা দান, শিক্ষা প্রসার চলছে(গভীর রাতের অন্তরঙ্গ শিক্ষার সুযোগও!), সেখান থেকে হিন্দি শিখে নাও আর হিন্দিকে নিজের নিজের মাতৃভাষা করে নাও, সব ক্ষোভ ঘুচে যাবে তখন এক দেশ, এক ভাষা, এক হিন্দ্জাতি হতে পারব মিছে বিরক্ত কোরো না
ভারতকে আমরা ”এক“ করেই ছাড়ব
===========================
নোট:
সংস্কৃতির বগলে টিআরপি-র থার্মোমিটার দিলে দেখা যাবে, যত সেক্স ততো
হু-হু করে বাড়ছে টিআরপি(Television Rating Point ) আলুর বেওসার মতো বস্তা ভরে ভরে সেক্স চালান দেওয়া হচ্ছে, আর নাফা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে কত্তাদের মদত তো আছেই, তা‘লে আর নাফা কত্তে বাধা কী? কিন্তুক নাফায় বাধা না থাকলেও অন্য রকম সব ব্যাপার স্যাপার হয়ে যাচ্ছে যে ভাষাটা তার মান হারিয়ে স্বৈরিণী বাড়ির লব্জ হয়ে উঠছে সংস্কৃতি নামক বস্তুটি কপ্পুরের মতো বাষ্প হয়ে উবে যাচ্ছে যদি তা উবে গেলে কত্তাদের মাথা ব্যথার কারণ না ঘটে, তবে দেশ নামক বস্তুটিও কি শেষ অবধি থাকবে? রাশিয়া ভেঙে যাবার অনেক কারণের মধ্যে একটা কারণ কিন্তু রাশিয়ান ভাষাও, ভাষা নিয়ে সেখানে রক্তপাত ঘটেছে সব ’একতা-ছালায়‘ পুরে চালান দেবার চেষ্টা করলে, আমও যায় ছালাও যায়
ভাষাচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ’ভারত সংস্কৃতি‘ গ্রন্থের ’জাতি সংস্কৃতি সাহিত্য‘ নিবন্ধে বলেছেন, ’রাষ্ট্রীয় বন্ধনে সঙ্ঘবদ্ধ বিবিধ-ভাষা-ভাষী একাধিক জন-সমষ্টির মধ্যে একটি বিশেষ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা স্বরূপ গ্রহণ করিলে, একতার সূত্র একটা অধিক হয় বটে, কিন্তু প্রান্তিক সত্তা বর্জন করিয়া সকলে মিলিত হইতে চাহে না বা পারে না সম্পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় ঐক্য স্থাপন করিতে হইলে, দেশে মাত্র একটি ভাষাকে রাখিতে হয়,-- অন্যগুলিকে হয় একেবারে ধ্বংস করিয়া ফেলিতে হয়, নতুবা নির্জীব ও ক্ষয়িষ্ণু করিয়া রাখিতে হয় এইরূপটি করিয়াই তবে গ্রেট ব্রিটেনে রাষট্রীয় ঐক্য ঘটিয়াছে-- স্কটল্যান্ডের
(২৩)
গেলিক ও ওয়েল্স্-এর ওয়েল্শ্-ভাষাকে বিলোপের পক্ষে আগাইয়া দিয়া ইংরেজির প্রতিষ্ঠা ও সঙ্গে সঙ্গে ইংরেজি ভাষাকে আশ্রয় করিয়া ব্রিটিশ একতা ফ্রান্সেও এইরূপে ... বহুভাষাময় রুষ সাম্রাজ্যেও ... চেষ্টা হইয়াছিল, ... কিন্তু ... ব্যর্থ হয়, -- ... বিভিন্ন প্রাদেশিক ভাষাগুলিকে ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ ঐক্যের প্রধান অন্তরায় মনে করিয়া, কেহ-কেহ হয়তো এগুলির সম্পূর্ণ
বিলোপসাধন ও ইহাদের স্থানে একমাত্র হিন্দীর অবস্থান কামনা করিবেন, কিন্তু কার্যতঃ তাহার সাধন করা অসম্ভব-- এক কোটি, দুই কোটি, পাঁচ কোটি লোকের
ভাষাকে এভাবে মারা যায় না বিশেষতঃ প্রান্তিক জনগণ যেখানে পৃথক প্রান্তিক সত্তা সম্বন্ধে সাত্মাভিমান হইয়া উঠিয়াছে,সেখানে এরূপ কল্পনা করাও যায় না এই প্রান্তিক সত্তার প্রাণই হইতেছে-- প্রান্তিক ভাষা‘ (পৃঃ১০০-১০১)
তীব্র প্রতিবাদ:
টিভি সিনেমা রেডিয়োতে এবার বেওসার নামে আরম্ভ হয়েছে বেলেল্লাপনা, বাংলাভাষা এবং সংস্কৃতিকে যা সমূলে ধ্বংস করছে নিজেদের মুনাফার জন্য এরা বাংলার গায়ে কালি লিপে দিচ্ছে ”আকাশের দেবতা অন্তর্যামী, আর ভবসংসারে সিঁধেল চোর“ যারা বাংলার সুকুমার বৃত্তিকে ধ্বংস
করছে, রবীন্দ্রচেতনাকে বিনষ্ট করছে-- এসব বিনষ্টকারীরা নিজেরাই ধ্বংস হোক বাংলাভাষা এবং বাংলা সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা তীব্র প্রতিবাদ করছি বাংলার গায়ে এই কুৎসিত কালিমা যারা লিপে দিচ্ছে তারা তা বন্ধ করুকনয়তো লক্ষ কোটি মানুষের প্রতিবাদ-- সমাজে তাদের বিচ্ছিন্ন করবে, স্তব্ধ করে দেবে বাংলাকে বেচে তারা মুনাফা লুটবে এ
চলতে পারে না, চলতে দেওয়া হবে না বাংলা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ভাষাক‘টির একটি, বাংলা রবীন্দ্রনাথের ভাষা, বাংলা নোবেল পাওয়া ভারতের একমাত্র ভাষা,
প্রায় শতবর্ষ আগে(১৯১৩ খ্রিস্টাব্দ শতবর্ষ তো আগত তার উৎসব-উদ্যোগ
কই?) যা বাংলায় এসেছিল, তখন ভারত ছিল পরাধীন, সেই পরাধীনতার অন্ধকার ঘুচিয়ে যে-ভাষায় আলোকময় নোবেল পুরস্কার এসেছিল সেই
বাংলাকে আজ কাদাগোলা ডোবায় পরিণত করার ব্যবসায়িক শঠতা বন্ধ হোক বাংলা ভারতের মধুরতম ভাষা, পৃথিবীর একটি অন্যতম মধুর ভাষা, জনসংখ্যার বিচারে বাংলা পৃথিবীতে চতুর্থ রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির বিষয়ে উল্লেখ করে জে.ডি. এন্ডারসন, ডি.লিট, আই সি এস, বঙ্গীয় তথা ঢাকা সাহিত্য-পরিষদের সদস্য, কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলাভাষার অধ্যাপক ১৯২০-তে বলেছেন--’সামগ্রিক বাংলা সাহিত্যের সমৃদ্ধি ও মাধুর্যের বিচারে এ এক বিলম্বিত ... স্বীকৃতি... মানবিকতা, কারুণ্য ও সরসতাগুণে এ-সাহিত্যের গরিমার কথা মানতেই হয়, মানতে হয় এর লক্ষণীয় বৈচিত্র, নম্য রীতিকলা এবং গদ্য-পদ্য নির্বিশেষে প্রকাশশৈলীর বহুমুখী ঐশ্বর্য ... পাশ্চাত্য সাহিত্যর অনুবাদ-বাহন হিসেবেও সমস্ত ভারতীয় ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠতা অবশ্যস্বীকার্য‘
(২৪)
(উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে ফরাসিভাষা-ভাষী অতুলনীয় বাংলা-লেখক, মাতৃভাষীর মতো করে বাংলালেখা ফাদার দ্যতিয়েনের বাংলায় লিখিত ’ডায়েরির ছেঁড়াপাতা‘ থেকে, পৃঃ-২৪)
”বাঙ্গলার শক্তি ও সৌন্দর্যের বিচার করিয়া একজন ইংরেজ বলিয়াছিলেন, ইতালিয় ভাষার মাধুর্য আর গ্রিক ভাষার শব্দ-গঠন-শক্তি, এ-দুই-ই বাংলা ভাষায় বিদ্যমান আধুনিক সাহিত্যের কথা ধরিলে, বাঙ্গলার বিশেষ মহত্ব স্বীকার করিতে হয় বাঙলা ভাষার অনুরাগী আর একজন ইংরেজ বলিয়াছিলেন, সমগ্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সাহিত্য-গৌরবে দুইটি প্রথম শ্রেণির ভাষা আছে-- একটি
ইংরেজি, অন্যটি বাংলা বাঙ্গলা সাহিত্য, প্রত্যক্ষভাবে বাঙালির এবং পরোক্ষভাবে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের মনকে আধুনিক জগতের
চিন্তাধারার উপযোগী করিতে সাহায্য করিয়াছে“--সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়,
বাঙ্গলা ভাষা প্রসঙ্গে, (১৯৭৫), পৃঃ-১২৬
খ্যাত জাপানি ’বাংলাভাষী‘ কাজুও আজুমা বিশ্ববঙ্গ সম্মেলন উপলক্ষে বাংলা আকাদেমি সভাকক্ষে, ৩০-১২-১৯৯৯ তারিখে বলেছেন, ”আমি পৃথিবীর কয়েকটি ভাষা শিখেছি বাংলাভাষা সবচেয়ে সুন্দর ও মধুর মনে করি“
”আমি বাংলাভাষার প্রেমে পড়েছি ভাষাটি কী সুন্দর কী মিষ্টি... বাংলা ভাষার সুর, উচ্চারণ, ছন্দ, তাল আমার কাছে খাঁটি মজা, ফুর্তি, আনন্দ“__ হানা টম্পসন[ইংরেজ মহিলা] ’এরই মাঝে বাংলার প্রাণ‘ দেশ, ২ ফেব্রুয়ারি, ২০০৬ বই সংখ্যা, পৃঃ ১২৯
চারুচন্দ্র ত্রিপাঠি (হিন্দি বিশ্বকোষের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বাংলা
বিশ্বকোষ তৈরির সেমিনারে[৩১-১০-১৯৮৭] হিন্দিতে ভাষণ দেন হিন্দিভাষী
কিন্তু বাংলা বোঝেন), বলেন__ ”এই দেশের সমৃদ্ধতম ভাষা বাংলা“
’প্রগতি প্রকাশন‘ মস্কো-এর বাংলা বিভাগের প্রধান রাইসা ভালুয়েভা
বলেছেন(১৯৭৫)__ ”আমার ধারণা যে বাংলাভাষা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ও সুরেলা ভাষাগুলোর মধ্যে অন্যতম“
এ ভাষার ঘাড়ে চেপে মুনাফা লোটার স্বপ্ন অচিরে ঘুচে যাবে ধাষ্টামো বন্ধ হোক, মানুষ সচেতন হয়েছে অন্য একটি ভাষার হাড় মজ্জা চুষে খেয়ে-- এবার মুনাফাখোরেরা নজর দিয়েছে ভারতের দ্বিতীয় সর্বাধিক জনসংখ্যার ভাষাটির দিকে, পৃথিবীর একটি জনগরিষ্ঠ ভাষার দিকে, তার উর্বর খেতের দিকে প্রতিবাদের পায়ের তলায় গুঁড়িয়ে, এভাবে লুটে খাওয়া তাদের ঘুচে যাবে এখুনি এসব বদমায়েশি বন্ধ হোক এসব বন্ধ হতেই হবে, আমরা বাংলাভাষীরা এসব হতে দেব না বাংলা আমাদের মা বাংলাকে স্বৈরিণী, পরচারিণী করার ঘৃণ্য জঘন্য ব্যভিচার বন্ধ হোক দরকার হলে আবার একুশে ফেব্রুয়ারি হবে-- এবার তা মরবার জন্য নয়, এবার হবে তা এক অন্য একুশে, এবার হবে অসাধু হীন দুর্বৃত্তদের বিনাশ করার, প্রতিরোধের সংগ্রাম
(২৫)
বাংলাভাষাকে অন্য ভাষার লেজুড় করার ধৃষ্ট প্রয়াস বন্ধ হোক বাংলার সমুন্নত ঋদ্ধ সংস্কৃতি ধ্বংস করার চক্রকে মানুষ আর সহ্য করবে না বাংলাভাষীরা স্বভাবত ভদ্র নম্র নিরীহ শিষ্ট বিনয়ী-- সেই সুযোগ নিয়ে তাকে বিধ্বস্ত করার চেষ্টা আর কতকাল মানুষ সইবে? মনে রাখা দরকার এই
বাঙলাতেই ছিলেন শহীদ ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, বাঘা যতীনেরা বিশ্বপ্রতাপ ইংরেজ এই বাঙালির ভয়ে কোলকাতা থেকে তাদের রাজধানী নিয়ে চুপে চুপে দিল্লি পালিয়ে গিয়েছিল বাঙালি নিরীহ বটে কিন্তু প্রয়োজনে তারা অগ্নিগিরি সেই
গিরির বিস্ফোরণ হবার আগেই বাংলার মতো সুমিষ্ট ভাষাকে কর্কশ কদাকার
হেয় করার জঘন্য চক্রান্ত বন্ধ হোক যারা সতর্কতার এ সময়-সংকেত বুঝতে
পারবে না, তারা অচিরে ধ্বংস হবে মুনাফা লোটার লোভে তরুণদের অনৈতিক অসাধু উপায়ে উন্মত্ত করে মাতিয়ে দেওয়া হচ্ছে এসব মোটেই মানুষের চোখ এড়াচ্ছে না এবার সময় হয়েছে এসব কুরুচিকর ধান্দাবাজি বন্ধ করার দেওয়াল
লিখন এরা পড়তে পারলে ভালো, নয়তো দেওয়ালের নীচে চাপা পড়েই এদের শেষ হতে হবে মানুষের কাছে আবেদন নোংরা কুৎসিত সিনেমা, টিভি,
ভিসিডি দেখবেন নাএতে বাঙালির শিক্ষা সংস্কৃতি শুধু ধ্বংস হচ্ছে না, প্রবলভাবে ক্ষয় হচ্ছে বাঙালির জীবিকার সকল সুযোগএকটুখানি চিন্তা করার জন্য সবার কাছে আবেদন করা হচ্ছেবাঙালির বোধবুদ্ধি অনেক ধী-পুষ্ট এবং উন্নত, একটুখানি ভাবলে তাঁরা সহজেই ব্যাপারটা বুঝতে পারবেননিজের জীবিকার ক্ষয় ঘটিয়ে তাঁরা অনৈতিক ব্যভিচারে উন্মত্ত হয়ে উঠবেন, এটা আশা করা যায় নাতাঁরা প্ররোচিত হয়ে, ভুল বার্তায় অন্ধের মতো পথ হাঁটতে শুরু করেছেনসেই তিমির থেকে তাঁরা বেরিয়ে আসুনবাংলার নাচ গান শিল্প
সংস্কৃতি বিশ্বমানের, তাকে হেলায় নষ্ট করবেন নাবিশ্বের শ্রেষ্ঠমানব প্রতিভা
যিনি, সেই রবীন্দ্রনাথ তো আমাদেরই ঘরের মানুষ আমরা কেন বিভ্রান্ত হয়ে হাতড়ে হাতড়ে অন্ধের হস্তী দর্শন করছি? বাঙালির মেধা, বাঙালির প্রতিভা তো বিলুপ্ত হয়ে যায়নি এই উপমহাদেশ থেকে বাঙালিরাই তো পরপর
নোবেল পেয়ে যাচ্ছে-- রবীন্দ্রনাথ, অমর্ত্য সেন, মুহাম্মদ ইউনুস আরও নোবেল আসবার অপেক্ষায় আছে, সেটা কি অনুভব করা যাচ্ছে না? আমরা কেন অকারণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছি? বিবেকের জাগরণের ডাক কি আর শোনা যায় না?
আমাদের সন্তান-সন্ততি ভাই বোন পরিজনকে আমরা কোথায় রেখে যাচ্ছি আমাদের এ ব্যাপারে কি সচেতন হওয়া উচিত নয়? আমাদের প্রত্যক্ষ মদত হয়তো এসব অসাধু ব্যবসায়ীরা পাচ্ছে না, কিন্তু চুপ করে থেকে অপ্রত্যক্ষ মদতই তো জুগিয়ে যাচ্ছি, নইলে কার সাধ্যি বাংলা ভাষা সংস্কৃতিকে এভাবে মত্ত পদদলিত করে? তাই আমাদের এই অনিচ্ছুক মদত দেওয়াও বন্ধ করা দরকার একটি ঘটনার সংবাদ কাগজে পড়া গেল-- একটি অল্প বয়সি মেয়ে স্কুলে আসত কপালে চুল ঝুলিয়ে স্কুলের শিক্ষিকা তাকে এই বয়সে এসব
(২৬)
মানসিকতা বন্ধ করার জন্য বললেও সে তা ’কেয়ার‘ করেনি শিক্ষিকা তখন তার কপালের জুলপি অন্যদের দিয়ে সবার সামনে কাটিয়ে দেন এর পরে অভিভাবকেরা স্কুলে এসে বিক্ষোভ দেখান তাঁদের মেয়ের এই ’লঞ্ছনায়‘
নিজেরা মেয়েকে শাসন করার ক্ষমতা রাখে না এতই অপদার্থ তারা, স্কুলের শিক্ষিকা সে দায় নিলে বরং তার উপরে হামলা হয়! এই করে আমরা, আমাদের পরের প্রজন্মকে কোন্ গোল্লায় রেখে যেতে চাই? বাবা-মাকে তারা মান্য করে না, সম্মান দেখায় না, স্কুলের শিক্ষিকাকে অবমাননা করে তাকে শাসন করলে,
সেটা সয় না এ কোথায় আমরা টেনে নামাচ্ছি আমাদের প্রিয় পরিজনকে?
যাহোক, আমাদের সাবধান হবার সময় এসেছে ভুল করে যেন আমরা
নিজেরা বিপথে চালিত না হই আমাদের সন্ততিদের সর্বনাশের পথের দরজা দেখিয়ে না দেই বাংলার সৌম্য সংস্কৃতি যেন আমরা ভুলে না যাই বাংলার অমেয় সম্পদ বৈষ্ণব পদাবলীর কথা যেন আমরা বিস্মৃত না হই বৈষ্ণব পদাবলী
পড়েনি যে-বাঙালি, তার জীবনের অনেকটাই ব্যর্থ সাহিত্যিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যবসায়ী, শেয়ার মার্কেটের পোকা হলেও, এ অমৃতভাণ্ডার অবহেলার নয় বলা যায় সে যুগে নোবেল পুরস্কার থাকলে, অনেকগুলি নোবেল পুরস্কার আমাদের কুলুঙ্গিতে সাজানো থাকত আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মঙ্গলের কথা আমরা যেন ভুলে না থাকি
পাশ্চাত্যে টিভি তাদের সমাজকে কোন্ গোল্লায় এনে ফেলেছে এদেশে টিভি আসার বেশ আগেই সে কথা আমরা শুনেছিকিন্তু আমরাও সেই
বেনোজল ঘরে ঢুকিয়েছি,তার প্রতিকারের কোনও ব্যবস্থা না নিয়েইতার অশুভ ফল কি আমরা এড়াতে পেরেছি? পারিনি যে, আমাদের এই ধ্বস্ত অবস্থা কি সেই কথাই প্রমাণ করে না? হিংসা, দ্বেষ, হিংস্রতা, যৌনতা, কুচক্র, মানুষকে
নিম্নমুখী করার সকল কলাকৌশল শেখানোর ল্যাবোরেটরি সদা সক্রিয় হাতেকলমে তার প্রয়োগ শিখিয়ে মানুষকে কোন্ অতলে যে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কে জানে? কিছুদিন আগে কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী প্রিয়রঞ্জন
দাশমুন্সী কুরুচিকর কিছু ব্যবস্থা আটকাতে গিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েন, পরে চাপের মুখে সেই ব্যবস্থা প্রত্যাহারও করে নিতে হয় বদ্ধ ঘরের সিনেমার জন্য আছে সেন্সর ব্যবস্থা, সেখানে প্রাপ্ত বয়স্কদের ছবি ছোটরা দেখতে পায় না আর টিভিতে দিনে রাতে সকল নোংরা বিষয়ই সবার জন্য উন্মুক্ত-দ্বার আশ্চর্য যে, সেই প্রাপ্ত-বয়স্কদের ছবিই টিভির মাধ্যমে শিশুর শৈশব-শয্যা অবধি প্রসারিত! কে দেখবে, কে নিয়ন্ত্রণ করবে সেসব?(’টিভির জন্যে সেন্সর বোর্ড থাকবে না কেন? থাকলে এতগুলি চ্যানেল এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন ভাবে নিজের নিজের টি আর পি বাড়াবার জন্য এমন দেশদ্রোহিতা থেকে বিরত থাকত‘--আজকাল,১৭ নভেম্বর,২০০৭,পৃঃ-৫)
বাংলাভাষার প্রতি কেন এই বিশেষ আক্রমণ? কারণ, বাংলা ভারতের শ্রেষ্ঠ
(২৭)
ভাষা, নোবেল পুরস্কার পাওয়া ভাষা, দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ ভাষা, জাতীয় সংগীতের ভাষা, রবীন্দ্রনাথের ভাষা, খোদ তাকেই ঘায়েল করতে পারলে অন্যরা তো প্রায় জলভাত তাই সব(শব) সাধনা বাংলার প্রতি নিয়োজিত!
এখনও সময় আছে, জোর করে যদি এখনও ধরা না-যায়, তবে দেশ, সমাজ, জাতি আমাদের অবহেলায় ধ্বসে যাবে, তা ঠেকানো যাবে না চোখ বুজে থেকে আগুন কি আটকানো যাবে? কিছু লোকের ’নাফার‘ জন্য দেশ ডুববে? সুস্থ সংস্কৃতি কি মানুষকে আনন্দ দিতে পারে না? কেবলই বিকৃতি প্রদর্শন করে মানুষকে শুষে নেওয়াই কি এসব মানুষের উদ্দেশ্য? তবে মানুষও তাদের
সার্বিকভাবে বর্জন করবে অশুভ কোনও কিছুকে শুভবোধ-সম্পন্ন মানুষ, কখনও
মানুষের সমাজে ঠাঁই দেবে না
আশুতোষ মুখোপাধ্যায় মহাশয়ের দুর্মর আশা-- ”জাতীয় অভিধান“ প্রকাশের মাধ্যমে হয়তো অনেকটা পূরণ হতে পারবে যাদবপুরের ’বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা
পরিষদ পরিকল্পিত ও সংকলিত‘ এটি একটি অত্যুচ্চ উদ্যোগ এটি কিন্তু মাত্র এক খণ্ড প্রকাশ পেয়েই থেমে আছে, এটিকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিতে হবে এটি নামে
’জাতীয় অভিধান‘ হলেও এমন অতি বলিষ্ঠ আয়োজন তথা বিশ্বজাতিক অভিধান পৃথিবীর যেকোনও ভাষাতেই দুর্লভ
কিছুদিন আগে একটি ভারতীয় বিখ্যাত ইংরেজি কাগজে, ’বিশ্বের প্রধান দেশের‘ তরুণ-তরুণীদের সম্পর্কে একটি সামাজিক খরব প্রকাশিত হয়েছে, সেটি পড়ে মানব-সভ্যতার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে শংকিত না হয়ে উপায় নেইঅতি-সভ্যতা মানে কি আবার সেই বনে ফিরে যাওয়া?ভারতেও সেই অতি-সভ্যতার ক্রমে শুভাগমন ঘটছেআর তার অবদান যে টিভির, এ সম্পর্কে কোনও বিতর্ক নেই সভ্যতার বিনাশ যে টিভির হাতে, সেটা ক্রমেই প্রকাশিত হচ্ছে তবে টিভির ’ব্যবসায়িক‘ ব্যবহারই যে সে জন্য দায়ী, সে কথা কে অস্বীকার করবে? গাধারা জল ঘোলা করে নাকি নিজেরা খায়, আর মানুষ ব্যবসা-ধান্দায় জল ঘোলা করে নবীন প্রজন্মের মগজে সেঁধিয়ে দেয়! গাধার তো চার পা তাই সে চতুষ্পদ
জন্তু, মানুষের চারটে পা নেই বলে তাকে বাধ্য হয়ে দ্বিপদ জন্তু বলতে হয় টিভি/সিনেমা/ভিডিয়ো, রেডিয়োর দক্ষতম দ্বিপদ জন্তুদের কৃৎকৌশল মানুষের সেই প্রায় হারিয়ে ফেলা ’জন্তু‘ নামক শুভনাম ফিরিয়ে দিচ্ছে চলো সবে বনে যাই অবশ্য এত বন তো আর কোথাও অবশিষ্ট নেই, তাই সমাজকেই জন্তু বাসের উপযুক্ত করে নিই! এরা ’যার পরে তার খায়, তারই ভিটায় ঘুঘু চরায়‘ পণ্ডিতেরা তো বলেছেন, ”ম্যান ইজ আ র্যাশনাল এনিম্যাল“ মনুষ্য-জন্তুর আপন ’আত্মগৌরব‘ ক্রমে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য টিভিব্যবসার একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য নয় কি৻ মানুষ অন্য জ্ঞাতি-জন্তুদের থেকে এত পৃথক হয়ে যাবে কেন?
===============================
২৮/০৩/২০১৮
সংযোজন:
আবার অনুভব করি-- "Hindi was selected
out of the 14 main languages of the country as enumerated in the Eighth
Schedule of / to that constitution, by the Constituent Assembly of India and
not by a parliament consisting of properly / directly
elected representatives of the people."*(Italics mine)“ p-8.
প্রথমবারের ভোটে সমান সমান হয়ে বস্তুত হিন্দি তো প্রত্যাখ্যাত হয়
দ্বিতীয় বারের ভোটে হিন্দির বিপক্ষে একভোট কমে যায়(কেন কমলো? তা নিয়ে ভাবতে যাবেন না ) সাকুল্যে সেই এক ভোটেই হিন্দির জয়
সংবিধান সংশোধন করতে ২/৩ অংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাগে, আর সংবিধান তৈরি করা যায় মাত্রই এক ভোটের গরিষ্ঠতায়? ‘করতে হবে’, সেটাই উদ্দেশ্য, এক ভোট
দু-ভোট কোনও ব্যাপার নয় আর দুই-তৃতীয়াংশের উদ্দেশ্যটা কি, এই বিধি যাতে সহজে পালটে ফেলা না যায় সে জন্য!
ইংরেজিকে সরিয়ে সেই স্থানে বসার যোগ্যতা কি কোনও ভারতীয় ভাষার হয়েছে? বাংলা ভারতের শ্রেষ্ঠভাষা, নোবেল পুরস্কার পাওয়া ভাষা, তারও সেই যোগ্যতা নেই, অন্যেরা তো বহু দূর
তারচেয়েও বড় কথা গণতান্ত্রিক নিরপেক্ষতা--
ইংরেজি সবার থেকে সমান দূরের, সবার পক্ষে সমান নিরপেক্ষ
গাছেরও খাব তলারও কুড়োবো গোছের হীনতা
গণতন্ত্রে চলে না
দেশের প্রধানমন্ত্রী বিদেশে গিয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে হিন্দি বলেন, আর দক্ষিণভারতে গিয়ে ইংরেজি বলেন! এই বৈচিত্র্য বড়ই বিচিত্র (২৮)
উল্লেখপঞ্জি:
সংবাদপত্র/পত্রিকা --
১আজকাল
২আনন্দবাজার পত্রিকা
৩গণশক্তি
৪তবু বাংলার মুখ
৫দেশ
৬দৈনিক বসুমতী
৭দৈনিক স্টেটসম্যান
৮যুগান্তর
৯সত্যযুগ
১০সোভিয়েত নারী
১১The Telegraph
১২The Times of India
বই --
১আনন্দসঙ্গী--আঃবাঃ পত্রিকা সংকলন
২আমাদের মাতৃভাষা-চেতনা ও ভাষা আন্দোলন--সম্পাদনা,
মুস্তাফা নূরউল ইসলাম
৩কাশীদাসী মহাভারত-- বেণীমাধব শীল সম্পাদিত
৪জাতীয় অভিধান-- বঙ্গীয় জাতীয় শিক্ষা পরিষদ
৫ডায়েরির ছেঁড়াপাতা -- ফাদার দ্যতিয়েন
৬বাঙ্গলা ভাষা প্রসঙ্গে-- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
৭ভারত সংস্কৃতি-- সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়
৮রবীন্দ্ররচনাবলী
৯ Language issue in the Indian Constituent Assembly1946-1950-
P. Kodanda Rao
১০ Letter from Sri B.G. Kher, Chairman, Official Language Commission,
to the President of India, Forwarding the report of the Commission.
১১ The Pageant of life (Life of B.G.Kher) ed. by - S.B.Kher & G.K.Rao
↓ ↓ ↓
সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী
এ নিবন্ধ লেখার আগে-পরে ঘটিত
১অসমে হিন্দিভাষীরা নিগৃহীত
২মুম্বইয়ে হিন্দিভাষীরা নিগৃহীত
৩মুম্বই বিধানসভায় একজন বিধায়ক হিন্দিতে শপথ নেওয়ায় লাঞ্ছিত তা নিয়ে সারা ভারত নিন্দামুখর (মরাঠিতে শপথ না নেওয়ায় বিধায়ক প্রহৃত বিধানসভায়, আঃবাঃ, ১০/১১/২০০৯, পৃঃ-এক) হিন্দিতে শপথ নেওয়ায় আজমিকে চড়! রাজ ঠাকরের দলের বিধায়ক সাসপেন্ড, আজকাল, ১০/১১/২০০৯, পৃঃ-এক
৪দক্ষিণভারতীয় মন্ত্রী লোকসভায় অহিন্দিভাষায় বক্তব্য বলার দাবি জানান (তামিলে বলতে চান মন্ত্রী, ধন্দে সংসদের সচিবালয়- আঃবাঃ, ১৭/১১/২০০৯,পৃঃ-পাঁচ)
৫তেলেঙ্গনা বিভাগ(যদিও তা একই ভাষার মানুষের ব্যাপার, তবু তা শাসনের অযোগ্যতা প্রমাণ করে) ভারত নিন্দামুখর
৬একজন আজকাল-এ (আজকাল, ১২/১২/২০০৯, শনিবার, পৃঃ-৪) চিঠি লিখেছেন, ১৯৯১-তে রেলওয়ের নিয়োগ পরীক্ষায়, কেন্দ্রটি পঃবঃ মাজদিয়াতে হওয়া সত্ত্বেও, সেখানে পরীক্ষা নেওয়ার ঘরে সব হিন্দিতে লেখা পত্রলেখক পড়তে না পেরে বিভ্রান্ত (পীযূষকান্তি সরকার, কদমতলা,হাওড়া,)
----------------------------
-- 00 --
পরবর্তী কালের সামান্য পরিমার্জন সহ
পরবর্তী কালের সামান্য পরিমার্জন সহ
No comments:
Post a Comment